পঁচিশে বৈশাখ । পঞ্চতন্ত্র । সৈয়দ মুজতবা আলি
একাদশ শ্রেণির দ্বিতীয় সেমিস্টার বাংলা বিষয়ের পাঠ্য পঁচিশে বৈশাখ । পঞ্চতন্ত্র । সৈয়দ মুজতবা আলি এখানে প্রদান করা হলো। শিক্ষার্থীরা নিম্নে প্রদান করা প্রবন্ধটি পাঠ করে এই প্রবন্ধের বড়ো প্রশ্নের উত্তর ওয়েবসাইট থেকে পড়তে পারবে।
পঁচিশে বৈশাখ । পঞ্চতন্ত্র । সৈয়দ মুজতবা আলি :
রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য পেয়েছিলুম, তাই যদি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে দেখি তাহলে আশা করি, সুশীল পাঠক এবং সহৃদয়া পাঠিকা অপরাধ নেবেন না।
রবীন্দ্রনাথ উত্তম উপন্যাস লিখেছেন, ছোট গল্পে তিনি মাপাসঁ, চেখফকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন, নাট্যে তিনি যে-কোন মিসটিকের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন, কবিরূপে তিনি বিশ্বজনের প্রশংসা অর্জন করেছেন, শব্দতত্ত্ব সম্বন্ধে তিনি যে গবেষণা করেছেন তার গভীরতা পণ্ডিতদের বির্বাক করে দিয়েছে, সত্যদ্রষ্টা হিসাবে তাঁর ব্যাখ্যান ভক্তজনের চিত্তজয় করতে সমর্থ হয়েছে, তাঁর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি আরো কত বৎসর ভারতবাসীকে নব নব শিক্ষা দেবে তার ইয়াত্তা নেই। আর গুরুরূপে তিনি যে শান্তিনিকেতন নির্মাণ করে। গিয়েছেন তার স্নিগ্ধচ্ছায়ায় বিশ্বজন একদিন সুখময় নীড় লাভ করবে। সে বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই।
আমার কিন্তু ব্যক্তিগত বিশ্বাস, রবীন্দ্ৰনাথ এসব উত্তীর্ণ হয়ে অজরামর হয়ে রইবেন তাঁর গানের জন্য।
সুরের দিক দিয়ে বিচার করব না। সুহৃদ শান্তিদেব ঘোষ তার ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতে’ এমন কোন জিনিস বাদ দেন নি যে সম্বন্ধে আপনি আমি আর পাঁচজনকে কিছু বলে দিতে পারি। আমি বিচার করছি, কিংবা বলুন মুগ্ধ হয়ে ভাবি যে, কতগুলো অপূর্ব গুণের সমন্বয় হলে পর এ রকম গান সৃষ্ট হতে পারে। সামান্য যে দু’চারটে ভাষা জানি তার ভিতর আমি চিরজীবন যে রসের সন্ধান করেছি। সে হচ্ছে গীতিরস। শেলি কীটস, গোটে হাউনে, হাফিজ আত্তার, কালিদাস জয়দেব, গালীব জওক এঁদের গান বলুন কবিতা বলুন সব কিছুর রসাস্বাদ করে। এ জীবন ধন্য মেনেছি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বার বার বলেছি–
‘এমনটি আর পড়িল না চোখে,
আমার যেমন আছে।’
তার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বার বার হার মেনেছি। রবীন্দ্রনাথের গান এমনি এক অখণ্ড রূপ নিয়ে হৃদয় মন অভিভূত করে ফেলে যে, তখন সর্বপ্রকারের বিশ্লেষণ ক্ষমতা লোপ পায়।
জর্মন যখন লীডার’ কিংবা ইরানীরা যখন গজল গায় একমাত্র তখনই আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত জাতীয় কিঞ্চিৎ রস পেয়েছি। তাই একমাত্র সেগুলোর সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের গানের তুলনা করে ঈষৎ বিশ্লেষণ করা যায়।
তখন ধরা পড়ে :
রবীন্দ্রনাথের গানের অখণ্ড, সম্পূর্ণ রূপ। বহু লীডার এবং গজল শুনে মনে হয়েছে। এ গান অপূর্ব, এ গান যদি আরো অনেকক্ষণ ধরে চলত। তবে আরো ভালো লাগত অর্থাৎ শুধু যে অতৃপ্ত রেখে গিয়েছে তাই নয়, অসম্পূর্ণ বলেই মনে হয়েছে। এ লীডার’ বা ‘গজল’ আরো কিছুক্ষণ ধরে চলতে পারতো। রবীন্দ্রনাথের গান কখনই অসম্পূর্ণরূপে আমার সামনে দাঁড়ায় নি। তাঁর গান শুনে যদি কখনো মনে হয়ে থাকে। এ গান আমাকে অতৃপ্ত রেখে গেল। তবে তার কারণ তার অসম্পূর্ণতা নয়, তার কারণ অতিশয় উচ্চাঙ্গের রসসৃষ্টি মাত্রই ব্যঞ্জনা এবং ধ্বনিপ্রধান। তার ধর্ম সম্পূর্ণ তৃপ্ত করে ও ব্যঞ্জনার অতৃপ্তি দিয়ে হৃদয়মন ভরে দেওয়া। তখন মনে হয়, এ গান আমার সামনে যে-ভুবন গড়ে দিয়ে গেল তার প্রথম পরিচয়ে তার সব কিছু আমার জানা হল না বটে, কিন্তু খেদ নেই, আবার শুনব তখন সে ভুবনের আরো অনেকখানি আমার কাছে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। আর এমনি করে একদিন সে ভুবন আমার নিতান্ত আপন হয়ে উঠবে। কোনো সন্দেহ নেই এরকম ধারাই হয়ে থাকে। কিন্তু আরেকটি কথা তার চেয়েও সত্য : রবীন্দ্রনাথের কোনো গানই কখনো নিজেকে সম্পূর্ণ নিঃশেষ করে না।
শব্দের, চয়ন, সে শব্দগুলো বিশেষ স্থলে সংস্থাপন এবং হৃদয়মনকে অভাবিত কল্পনাতীত নূতন শব্দের ভিতর দিয়ে উন্মুখ রেখে ভাবে, অর্থে, মাধুর্যের পরিসমাপ্তিতে পৌঁছিয়ে দিয়ে গান যখন সাঙ্গ হয় তখন প্রতিবারই হৃদয়ঙ্গম করি, এ গান আর অন্য কোনো রূপ নিতে পারতো না-নটরাজের মূর্তি দেখে। যেমন মনে হয়, নটরাজ অন্য কোনো অঙ্গভঙ্গি দিয়ে আমার চোখের সামনে নৃত্যুকে রূপায়িত করতে পারতেন না। তাই বলি, নটরাজের প্রত্যেকটি অঙ্গভঙ্গির মত রবীন্দ্রনাথের গানের প্রত্যেকটি শব্দ।
লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়ই, চমৎকার সুর তাল জ্ঞান, মধুরতম কণ্ঠ, তবু কোনো কোনো গায়কের গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গান ফিকে, পানসে অর্থাৎ ফ্ল্যাট বলে মনে হয়। কেন এরকম ধারা হয় তার কারণ অনুসন্ধান করলে অধিকাংশ স্থলেই দেখতে পাবেন, গায়কের যথেষ্ট শব্দ সম্মান বোধ নেই বলে প্রতিটি শব্দ রসিয়ে রসিয়ে গাইছেন না। আর তাই যেন নটরাজের প্রতিটি অঙ্গ আড়ষ্ট হয়ে গিয়ে তাঁর নৃত্য বন্ধ হয়ে গেল।
মৃত্তিকার বন্ধন থেকে রবীন্দ্রনাথ কত শতবার আমাদের নিয়ে গিয়েছেন ‘নীলাম্বরের মৰ্মমাঝে’। আবার যখন তিনি আমাদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন তখন এই মৃত্তিকাই স্বর্গের চেয়ে অধিকতর মধুময় হয়ে ওঠে’।
‘তারায় তারায় দীপ্তশিখার অগ্নি জ্বলে
নিদ্রাবিহীন গগনতলে—’
শুনে কি কল্পনা করতে পারি যে
‘ঐ আলোক-মাতাল স্বৰ্গসভার মহাঙ্গন,
কোথায় ছিল কোন যুগে মোর নিমন্ত্রণ।’
তারপর যখন মনকে তৈরি করলুম। সেই স্বৰ্গসভার নব নব অভিজ্ঞতার জন্য তখন আবার হঠাৎ আমি
‘কালের সাগর। পাড়ি দিয়ে এলেম চলে
নিদ্রাবিহীন গগনতলে।’
তারপর এ-ধারার কি অপরূপ বর্ণনা
‘হেথা মন্দমধুর কানাকানি জলে স্থলে
শ্যামল মাটির ধরাতলে।
হেথা ঘাসে ঘাসে রঙিন ফুলের আলিম্পন
বনের পথে আঁধার-আলোয় আলিঙ্গন।’
কখনো স্বর্গে কখনো মর্ত্যে, আপনি অজানাতে এই যে মধুর আনাগোনা, মানুষকে দেবতা বানিয়ে, আবার তাকে দেবতার চেয়ে মহত্তর মানুষ করে তোলা-মাত্র কয়েকটি শব্দ আর একটুখানি সুর দিয়ে—এ আলৌকিক কর্ম যিনি করতে পারেন। তিনিই বিশ্বকর্ম মহাত্মা’।