আদরিনী । প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়
দ্বাদশ শ্রেণির নতুন সিলেবাস অনুসারে সেমিস্টার পদ্ধতিতে যে নতুন পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়েছে, তার প্রস্তুতির লক্ষ্যে WBNOTES.IN ওয়েবসাইটের পক্ষ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির তৃতীয় সেমিস্টার প্রদান করতে চলা শিক্ষার্থীদের জন্য আদরিনী । প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় গল্পটি প্রদান করা হলো। যে সকল শিক্ষার্থীরা একাদশ শ্রেণির দ্বিতীয় সেমিস্টার প্রদান করে দ্বাদশ শ্রেণির তৃতীয় সেমিস্টার বাংলা বিষয়ের জন্য পড়াশোনা শুরু করেছো তাদের জন্য দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা তৃতীয় সেমিস্টার -এর (Class Twelve 3rd Semester Bengali) আদরিনী গল্পটি এবং আদরিনী গল্পের MCQ প্রশ্নের উত্তর -এর লিঙ্ক নিম্নে প্রদান করা হলো।
আদরিনী । প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় :
প্রথম পরিচ্ছেদ
পাড়ার নগেন নগেন ড়াক্তার ও জুনিয়ার উকিল কুঞ্জবিহারীবাবু বিকালে পান চিবাইতে চিবাইতে, হাতের ছড়ি দুলাইতে দুলাইতে জয়রাম মোক্তারের নিকট আসিয়া বলিলেন-“মুখুয্যে মশায়, পীরগঞ্জের বাবুদের বাড়ী থেকে আমরা নিমন্ত্রণ পেয়েছি, এই সোমবার দিন মেঝবাবুর মেয়ের বিয়ে। শুনছি নাকি ভারি ধূমধাম হবে। বেনারস থেকে বাই আসছে, কলকাতা থেকে খেমটা আসছে। আপনি নিমন্ত্রণ পেয়েছেন কি?”
মোক্তার মহাশয় তাঁহার বৈঠকখানার বারান্দায় বেঞ্চিতে বসিয়া হুঁকা হাতে করিয়া তামাক খাইতেছিলেন। আগন্তুকগণের এই প্রশ্ন শুনিয়া, হুঁকাটি নামাইয়া ধরিয়া, একটু উত্তেজিত স্বরে বলিলেন- কি রকম? আমি নিমন্ত্রণ পাব না কি বকম? জান, আমি আজ বিশ বচ্ছর ধরে তাদের এস্টেটের বাঁধা মোক্তার? -আমাকে বাদ দিয়ে তারা তোমাদের নিমন্ত্রণ করবে, এইটে কি সম্ভব মনে কর?”
জয়রাম মুখোপাধ্যায়কে ইঁহারা বেশ চিনিতেন সকলেই চিনে। অতি অল্প কারণে তাঁহার তীব্র অভিমান -উপস্থিত হয়-অথচ হৃদয়খানি স্নেহে, বন্ধু বাৎসল্যে কুসুমের মত কোমল, ইহা যে তাঁহার সঙ্গে কিছুদিনও ব্যবহার করিয়াছে, সেই জানিয়াছে। উকিল বাবু তাড়াতাড়ি বলিলেন-“না-না- সে কথা নয়-সে কথা নয়। আপনি রাগ করলেন মুখুয্যে মশায়? আমরা কি সে ভাবে বলছি? এ জেলার মধ্যে এমন কে বিষয়ী লোক আছে, যে আপনার কাছে উপকৃত নয় আপনার খাতির না করে? আমাদের জিজ্ঞাসা করবার তাৎপর্য্য এই ছিল যে, আপনি সে দিন পীরগঞ্জে যাবেন কি?”
মুখোপাধ্যায় নরম হইলেন। বসিলেন “ভায়ারা, বস।”- বলিয়া সমুখস্থ আর এক খানি বেঞ্চ দেখাইয়া দিলেন। উভয়ে উপবেশন করিলে বলিলেন- “পীরগঞ্জে গিয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা করা আমার পক্ষে একটু কঠিন বটে। সোম মঙ্গল দুটো দিন কাছারি কামাই হয়। অথচ না গেলে তাবা ‘ভাবি মনে দুঃখিত হবে। তোমৰা যাচ্ছ?”
নগেন্দ্রবাবু বলিলেন- যাবার ত খুবই ইচ্ছে-কিন্তু অত দূর যাওয়া ত সোজা নয়। ঘোড়াব গাড়ীর পথ নেই। গোরুর গাড়ী করে যেতে হলে, যেতে দুদিন আসতে দুদিন। পালকী করে যাওয়া সেও যোগাড় হওয়া মুস্কিল। আমরা দুজনে তাই পরামর্শ করলাম, যাই মুখুয্যে মশায়কে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি, তিনি যদি যান, নিশ্চয়ই রাজবাড়ী থেকে একটা এই টাতী আনিয়ে নেবেন এখন, আমরা দুজনেও তাঁর সঙ্গে সেই হাতীতে দিব্যি আরামে যেতে পারব।”
মোক্তার মহাশয় স্মিতমুখে বলিলেন-“এই কথা? তার জন্যে আর ভাবনা কি ভাই?-মহাবাজ নরেশচন্দ্র ও আমার আজকের মক্কেল নন-ওঁর বাপের আমল থেকে আমি ওদের মোক্তার। আমি কাল সকালেই রাজবাড়ীতে চিঠি লিখে পাঠাচ্ছি-সন্ধ্যে নাগাদ হাতী এসে যাবে এখন।”
কুঞ্জবাবু বলিলেন-“দেখলে হে ড়াক্তার, আমি ত বলেইছিলাম-অত ভাবছ কেন মুখুয্যে মশায়ের কাছে গেলেই একটা উপায় হয়ে যাবে। তা মুখুয্যে মশায়, আপনাকেও কিন্তু আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। না গেলে ছাড়ছিনে।”
“যাব বইকি ভায়া-আমিও যাব। তবে আমার ত বাই খেমটা শোনবার বযস নেই-তোমরা শুনো। আমি মাথায় এক পগ্গ্ন বেঁধে, একটি থেলো হুঁকো হাতে করে, লোকজনের অভ্যর্থনা করব, কে খেলে কে না খেলে দেখব–তদারক করে বেড়াব। আর তোমরা বসে শুনবে-‘পেয়ালা ‘মুঝে ভর দে’-কেমন?”-বলিয়া মুখোপাধ্যায় মহাশয় হা-হা করিয়া হাসিতে লাগিলেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পরদিন রবিবার। এ দিন প্রভাতে আহ্নিক পূজাটা মুখুয্যে মহাশয় একটু ঘটা করিয়াই করিতেন। বেলা ৯টার সময় পূজা সমাপন করিয়া জলযোগান্তে বৈঠকখানায় আসিয়া বসিলেন। অনেকগুলি মক্কেল উপস্থিত ছিল, তাহাদের সহিত কথাবার্তা কহিতে লাগিলেন। হঠাৎ সেই হাতীর কথা মনে পড়িয়া গেল। তখন কাগজ কলম লইয়া, চশমাটি পরিয়া, “প্রবল প্রতাপান্বিত শ্রীল শ্রীমন্মহারাজ শ্রীনরেশচন্দ্র বায়চৌধুরী বাহাদুর আশ্রিত-জন প্রতিপালকেষ” পাঠ লিখিয়া, দুই তিনদিনের জন্য একটি সুশীল ও সুবোধ হস্তী প্রার্থনা করিয়া পত্র লিখিলেন। পূর্ব্বেও আবশ্যক হইলে তিনি কতবার এইরূপে মহারাজের হস্তী আনাইয়া লইয়াছেন। একজন ভৃত্যকে ড়াকিয়া পত্রখানি লইয়া যাইতে আজ্ঞা দিয়া, মোক্তার মহাশয় আবার মক্কেলগণের সহিত কথোপকথনে প্রবৃত্ত হইলেন।
শ্রীযুক্ত জয়বাম মুখোপাধ্যায়ের বয়স এখন পঞ্চাশৎ পার হইয়াছে। মানুষটি লম্বা ছাঁদের-রঙটি আর একটু পরিষ্কার হইলেই গৌববর্ণ বলা যাইতে পারিত। গোঁপগুলি মোটা মোটা-কাঁচায় পাকায় মিশ্রিত। মাথার সম্মুখভাগে টাক টা মোটা-ক আছে। চক্ষু দুইটি বড় বড়, ভাসা ভাসা। তাঁহার হৃদয়ের কোমলতা যেন হৃদয় ছাপাইয়া, এই চক্ষু দুইটি দিয়া উছলিয়া পড়িতেছে।
ইঁহার আদিবাস যশোর জেলায়। এখানে যখন প্রথম মোক্তারী করিতে আসেন, তখন এদিকে রেল খোলে নাই। পদ্মা পার হইয়া কতক নৌকাপথে, কতক গোরুর গাড়ীতে, কতক পদব্রজে আসিতে হইয়াছিল। সঙ্গে কেবলমাত্র একটি ক্যাম্বিসের ব্যাগ এবং একটি পিতলের ঘটি ছিল। সহায় সম্পত্তি কিছুই ছিল না। মাসিক তেরো সিকায় একটি বাসা ভাড়া লইয়া, নিজ হাতে রাঁধিয়া খাইয়া মোক্তারী ব্যবসায় আবস্তু করিয়া দেন। এখন সেই জযরাম মুখোপাধ্যায় পাকা দালান কোঠা করিয়াছেন, বাগান করিয়াছেন, পুকুর কিনিয়াছেন, অনেকগুলি কোম্পানীর কাগজও কিনিয়াছেন। যে সময়ের কথা বলিতেছি, তখন এ জেলায় ইংবাজীওয়ালা মোক্তারের আবির্ভাব হইয়াছে বটে- কিন্তু জয়রাম-মুখুয্যেকে তাহারা কেহই হটাইতে পারে নাই। তখনও ইনি এ জেলায় প্রধান মোক্তার বলিয়া গণ্য।
মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের হৃদয়খানি অত্যন্ত কোমল ও স্নেহপ্রবণ হইলেও, মেজাজটা কিছু রুক্ষ? যৌবনকালে ইনি রীতিমত বদরাগী ছিলেন-এখন রক্ত অনেকটা ঠাণ্ডা হইয়া আসিয়াছে। সেকালে, হাকিমেরা একটু অবিচার অত্যাচার কিছু রুক্ষ? যৌ করিলেই মুখুয্যে মহাশয় বাগিয়া চেঁচাইয়া অনর্থপাত করিয়া তুলিতেন। একদিন এজলাসে এক ডেপুটির সহিত ইহার বিলক্ষণ বচসা হইয়া যায়। বিকালে বাড়লী আসিয়া দেখিলেন, তাঁহার মঙ্গলা গাই একটি এঁড়ে বাছুর প্রসব করিয়াছে। টা তখন আদর করিয়া উক্ত ডেপুটিবাবুর নামে বাছুরটির নামকরণ করিলেন। ডেপুটিবাবু লোকপরম্পরায় ক্রমে এ কথা শুনিয়াছিলেন, এবং বলা বাহুল্য, নিতান্ত প্রীতিলাভ করেন নাই। আর একবার, এক ডেপুটির সম্মুখে মুখুয্যে মহাশয় আইনের তর্ক করিতেছিলেন, কিন্তু হাকিম কিছুতেই ইঁহার কথায় সায় দিতেছিলেন না। অবশেষে রাগের মাথায় জয়বাম বলিয়া বসিলেন- “আমার স্ত্রীর যতটুকু আইন জ্ঞান আছে, হুজুরের তাও নেই দেখছি”। সেদিন আদালত অবমাননার জন্য মোক্তার মহাশয়ের পাঁচ টাকা জরিমানা হইয়াছিল। এই আদেশের বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্ট অবধি লডিয়াছিলেন। সর্ব্বসুদ্ধ, ১৭০০ টাকা ব্যয় করিয়া এই পাঁচটা টাকা জরিমানা হুকুম রহিত করিয়াছিলেন।
মুখোপাধ্যায় যেমন অনেক টাকা উপার্জন করিতেন, তেমনি তাঁহার ব্যয়ও যথেষ্ট ছিল। তিনি অকাতরে অন্নদান করিতেন। অত্যাচারিত, উৎপীড়িত গরীব লোকের মোকদ্দমা তিনি কত সময় বিনা ফিসে, এমন কি নিজে অর্থব্যয় পর্য্যন্ত করিয়া, চালাইয়া দিয়াছেন।
প্রতি রবিবার অপরাহ্নকালে পাড়ার যুবক-বৃদ্ধগণ মোক্তার মহাশয়ের বৈঠকখানায় সমবেত হইয়া তাস পাশা খেলিয়া থাকেন। অদ্যও সেইরূপ অনেকে আগমন করিয়াছেন-পূর্ব্বোক্ত ড়াক্তারবাবু ও উকিলবাবুও আছেন। হাতীকে বাঁধিবার জন্য বাগানে খানিকটা স্থান পবিষ্কৃত করা হইতেছে, হাতী রাত্রে খাইবে বলিয়া বড় বড় পাতাসুদ্ধ কয়েকটা কলাগাছ ও অন্যান্য বৃক্ষের ড়াল কাটাইয়া রাখা হইতেছে, মোক্তার মহাশয় সে সমস্ত তদারক করিতেছেন। মাঝে মাঝে বৈঠকখানায় আসিয়া, কোনও ব্রাহ্মণের হাত হইতে হুঁকাটি লইয়া দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দুই চারি টান দিয়া আবার বাহির হইয়া যাইতেছেন।
সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে জয়বাম, বৈঠকখানায় বসিয়া পাশাখেলা দেখিতেছিলেন। এমন সময় সেই পত্রবাহক ভৃত্য ফিরিয়া আসিয়া বলিল-“হাতী গাওয়া গেল না।”
কুঞ্জবাবু নিরাশ হইয়া বলিয়া উঠিলেন- “অ্যা-পাওয়া গেল না?”
নগেন্দ্রবাবু বলিলেন-“তাই ত। সব মাটি?”
মোক্তার মহাশয় বলিলেন-“কেন রে, হাতী পাওয়া গেল না কেন? চিঠির জবাব এনেছিস?” – ভৃত্য বলিল-“আজ্ঞে না। দেওয়ানজীকে গিয়ে চিঠি দিলাম। তিনি চিঠি নিয়ে মহারাজের কাছে গেলেন। খানিক বাদে ফিরে এসে বললেন, বিয়ের নেমন্তন্ন হয়েছে তার জন্যে হাতী কেন? গোরুর গাড়ীতে আসতে বোলো।”
এই কথা শুনিবামাত্র জয়রাম ক্ষোভে, লজ্জায়, রোষে যেন একেবারে ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া উঠিলেন। তাঁহাব হাত পা ঠক ঠক্ করিয়া কাঁপিতে লাগিল। দুই চক্ষু দিয়া রক্ত ফাটিযা পড়িতে লাগিল। মুখমণ্ডলের শিরা-উপশিরাগুলি স্ফীত হইয়া উঠিল। কম্পিতস্বরে, ঘাড় বাঁকাইয়া বারংবার বলিতে লাগিলেন- “হাতী দিলে না। হাতী দিলে না।”
সমবেত ভদ্রলোকগণ ক্রীড়া বন্ধ করিয়া হাত গুটাইযা বসিলেন। কেহ কেহ বলিলেন-“তবে আর কি করবেন মুখুয্যে মশায়। পবেব জিনিষ, জোর ত নেই। একখানা ভাল দেখে গোরুর গাড়ী ভাড়া করে নিয়ে রাত্রি দশটা দশটা এগারোটার সময় বেবিয়ে পড়ুন, ঠিক সময পৌঁছে যাবেন। ঐ ইমামদ্দি শেখ একযোড়া নূতন বলদ কিনে এনেছে – খুব দ্রুত যায়।”
জয়রাম বক্তার দিকে দৃষ্টিমাত্র না করিযা বলিলেন-“না। গোরুর গাড়ীতে চড়ে আমি যাব না। যদি হাতী চড়ে যেতে পারি, তবেই যাব, নইলে এ বিবাহে আমার যাওয়াই হবে না।”
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
শহর হইতে দুই তিন ক্রোশের মধ্যে দুই তিনজন জমিদারেব হস্তী ছিল। সেই বাত্রেই জয়বাম তত্তৎ স্থানে লোক পাঠাইয়া দিলেন, যদি কেহ হস্তী বিক্রয় করে, তবে কিনিবেন। রাত্রি দুই প্রহরের সময় সময় একজন ফিরিয়া আসিয়া বলিল-“বীরপুরের উমাচরণ লাহিড়ীর একটি মাদী হাতী আছে- এখনও বাচ্চা। বিক্রী করবে, কিন্তু বিস্তর দাম চায়।”
“কত?”..”দু হাজার টাকা”
“খুব বাচ্চা?”‘
“না, সওয়ারি নিতে পারবে।”
“কুছ পরওয়া নেই। তাই কিনব। এখনই তুমি যাও। কাল সকালেই যেন হাতী আসে। লাহিড়ী মশায়কে আমার নমস্কার জানিয়ে বোলো, হাতীর সঙ্গে যেন কোন বিশ্বাসী কর্মচারী পাঠিয়ে দেন, হাতী দিয়ে টাকা নিয়ে যাবে।
পবদিন বেলা সাতটার সময় হস্তিনী আসিল। তাহার নাম আদরিণী। লাহিড়ী মহাশয়ের কর্মচারী রীতিমত ষ্ট্যাম্প কাগজে ‘রসিদ লিখিয়া দিয়া দুই হাজার টাকা লইয়া প্রস্থান করিল। বাড়ীতে হাতী আসিবামাত্র পাড়ার তাবৎ বালক বালিকা আসিয়া বৈঠকখানার উঠানে ভিড় করিয়া দাঁড়াইল। দুই একজন অশিষ্ট বালক সুর করিয়া বলিতে লাগিল-“হাতী, তোর গোদা পাযে নাতি।” বাড়ির বালকেরা ইহাতে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল এবং অপমান করিয়া তাহাদিগকে বহিষ্কৃত করিয়া দিল।
হস্তিনী গিয়া অন্তঃপুরদ্বারের নিকট দাঁড়াইল। মুখুয্যে মহাশয় বিপত্নীক-তাঁহার জ্যেষ্ঠা পুত্রবধূ একটি ঘটীতে জল লইয়া সভয় পদক্ষেপে বাহির হইয়া আসিলেন। কম্পিত হস্তে তাহার পদচতুষ্টয়ে সেই জল একটু একটু ঢালিয়া দিলেন। মাহুতের ইঙ্গিতানুসারে আদরিণী তখন জানু পাতিয়া বসিল। বড়বধূ তৈল ও সিন্দুরে তাহার ললাট রাঙা করিয়া দিলেন। ঘন ঘন শঙ্খধ্বনি হইতে লাগিল। আবার দাঁড়াইয়া উঠিলে, একটা ধামায় ভরিয়া আলোচাল, কলা ও অন্যান্য মাঙ্গল্যদ্রব্য তাহার সম্মুখে রক্ষিত হইল-শুঁড় দিয়া তুলিয়া তুলিয়া কতক সে খাইল, অধিকাংশ ছিটাইয়া দিল। এইরূপে বরণ সম্পন্ন হইলে, রাজহস্তীর জন্য সংগৃহীত সেই কদলীকাণ্ড ও বৃক্ষশাখা আদরিণী ভোজন করিতে লাগিল।
নিমন্ত্রণ রক্ষা করিয়া পীরগঞ্জ হইতে ফিরিবার পরদিন বিকালেই মহারাজ নরেশচন্দ্রের সহিত মুখোপাধ্যায় মহাশয় সাক্ষাৎ করিতে গেলেন। বলা বাহুল্য হস্তীপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়াই গেলেন। মহারাজের দ্বিতল বৈঠকখানার নিম্নে বিস্তৃত প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গণের অপর প্রান্তে হস্তে প্রবেশের সিংহদ্বার। বৈঠকখানায় বসিয়া সমস্ত প্রাঙ্গণ ও সিংহদ্বারের বাহিরেরও অনেক দূর অবধি মহারাজের দৃষ্টিগোচর হইয়া থাকে।
রাজসমীপে উপনীত হইলে মুখোপাধ্যায় মহাশয় তাঁহাকে আশীর্বাদ করিয়া আসন গ্রহণ করিলেন। মোকদ্দমা ও বিষয়-সংক্রান্ত দুই চারি কথার পর মহারাজ জিজ্ঞাসা করিলেন- “মুখুয্যে মশায়, ও হাতীটি কার?”
মুহূয্যে মহাশয় বিনীতভাবে বলিলেন- “আজ্ঞে, হজুর বাহাদুরেরই হাতী।”
মহারাজ বিস্মিত হইয়া বলিলেন- “আমার হাতী। কই ও হাতী ত কোনও দিন আমি দেখিনি। কোথা থেকে এল?”
আজ্ঞে, বীরপুরের উমাচরণ লাহিড়ীর কাছ থেকে কিনেছি।”
অধিকতর বিস্মিত হইয়া রাজা বলিলেন- “আপনি কিনেছেন।”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“তবে বললেন আমার হাতী?”
বিনয় শ্লেষসূচক-ঠিক বোম বোঝা গেল না – একটু মৃদু হাস্য করিয়া জয়রাম বলিলেন- “যখন হুজুর বাহাদুরের দ্বারাই প্রতিপালন হচ্ছি-আমিই যখন আপনার-তখন ও হাতী আপনার বই আর কার?”-সন্ধ্যার পর গৃহে ফিরিয়া, বৈঠকখানায় বসিয়া, সমবেত বন্ধুমণ্ডলীর নিকট মুখোপাধ্যায় এই কাহিনী সবিস্তারে বিবৃত করিলেন। হৃদয় হইতে সমস্ত ক্ষোভ ও লজ্জা আজ তাঁহার মুছিয়া গেল। কয়েক দিন পরে আজ তাঁহার সুনিদ্রা হইল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
(উল্লিখিত ঘটনার পর সুদীর্ঘ পাঁচটি বৎসর অতীত হইয়াছে-এই পাঁচ বৎসরে মোক্তার মহাশয়ের অবস্থার অনেক পরিবর্তন হইয়াছে।)
‘নতুন নিয়মে পাশ করা শিক্ষিত মোক্তারে জেলাকোর্ট ভরিয়া গিয়াছে। শিথিল নিয়মের আইন-ব্যবসায়ীর আর কদর নাই। ক্রমে ক্রমে মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের আয় কমিতে লাগিল। পূর্ব্বে যত উপার্জন করিতেন এখন তাহার অর্দ্ধেক হয় কি না সন্দেহ। অথচ ব্যয় প্রতি বৎসর বর্ধিতই হইতেছে। তাঁহার তিনটি পুত্র। প্রথম দুইটি মূর্খ বংশবৃদ্ধি ছাড়া আর কোনও কর্ম্ম করিবার যোগী নহে। কনিষ্ঠ পুত্রটি কলিকাতায় পড়িতেছে-সেটি যদি কালক্রমে মানুষ হয় এইমাত্র ভরসা।
ব্যবসায়ের প্রতি মুখোপাধ্যায়ের আর সে অনুরাগ নাই-বড় বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছেন। ছোকরা মোক্তারগণ, যাহাদিগকে এক সময় উলঙ্গাবস্থায় পথে খেলা করিতে দেখিয়াছেন, তাহারা এখন শামলা মাথায় দিয়া (মুখোপাধ্যায় পাগড়ী বাঁধিতেন, সেকালে মোক্তারগণ শামলা ব্যবহার করিতেন না।) তাঁহারা প্রতিপক্ষে দাঁড়াইয়া চোখ মুখ ঘুরাইয়া ফর ফর করিয়া ইংরাজিতে হাকিমকে কি বলিতে থাকে, তিনি কিছুই বুঝিতে পারেন না। পার্শ্বস্থিত ইংরাজি জানা জুনিয়রকে জিজ্ঞাসা করেন, “উনি কি বলছেন?”-জুনিয়র তর্জমা করিয়া তাঁহাকে বুঝাইতে বুঝাইতে অন্য প্রসঙ্গ উপস্থিত হয়, মুখের জবাব মুখেই রহিয়া যায়-নিষ্ফল রোষে তিনি ফুলিতে থাকেন। তাহা ছাড়া, পূর্ব্বে হাকিমগণ মুখুয্যে মহাশয়কে যেরূপ শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিতেন, এখনকার নব্য হাকিমগণ আর তাহা করেন না। ইঁহাদের যেন বিশ্বাস, যে ইংরাজি জানে না, সে মনুষ্যপদবাচ্যই নহে। এই সকল কারণে স্থির করিয়াছেন, কৰ্ম্ম হইতে এখন অবসর গ্রহণ কবাই শ্রেয়ঃ। তিনি যাহা সঞ্চয় করিযাছেন, তাহাব সুদ হইতে কোনও রকমে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিবেন। প্রায ষাট বৎসব বয়স হইল-চিরকালই কি খাটিবেন? বিশ্রামেব সময় কি হয় নাই? বড় ছেলেটি যদি মানুষ হইত-দুই টাকা যদি বোজগার করিতে পারিত- তাহা হইলে এতদিন কোন কালে মুখোপাধ্যায় মহাশয় অবসর লইতেন, বাড়ীতে বসিয়া হরিনাম করিতেন। কিন্তু আর বেশী দিন চলে না। তথাপি আজি কালি করিয়া আরও এক বৎসর কাটিল।
এই সময় দায়বায় একটি খুনী মোকদ্দমা উপস্থিত হইল। সেই মোকদ্দমার আসামী জয়রাম মুখোপাধ্যায়কে নিজ মোক্তার নিযুক্ত করিল। একজন নূতন ইংরাজ জর্জ আসিয়াছেন-তাঁহাবই এজলাসে বিচার। — তিনদিন যাবৎ মোকদ্দমা চলিল। অবশেষে মোক্তার মহাশয় উঠিয়া “জজসাহেব বাহাদুর ও এসেসাব মহোদয়গণ বলিয়া বক্তৃতা সাবস্ত করিলেন। বক্তৃতাশেষে এসেসাবান মুখোপাধ্যায়ের মক্কেলকে নির্দোষ সব্যস্ত করিলেন-জজসাহেবও তাঁহাদের অভিমত স্বীকার করিয়া আসামীকে অব্যাহতি দিলেন।
জজসাহেবকে সেলাম করিয়া, মোক্তার মহাশয় নিজ কাগজপত্র বাঁধিতেছেন, এমন সমৎ জজসাহেব পেস্তারকে জিজ্ঞাসা করিলেন “এ উঠিলটির নাম কি?”
পেস্কার বলিল – “উহার নাম জয়রাম জয়রাম মুখার্জেী, উনি উকিল নহেন – মোক্তার। প্রসন্নহাস্যের সহিত জজসাহেব জয়রামের প্রতি চাহিয়া বলিলেন – ‘আপনি মোক্তার?’। জয়রাম বলিলেন – ‘হ্যাঁ হুজুর, আমি আপনার তাঁবেদার।
জজসাহেব পূর্ববৎ বলিলেন আপনি মোক্তার। আমি মনে করিযাছিলাম আপনি উকিল। যেরূপ দক্ষতার সহিত আপনি নোকদ্দমা চালাইয়াছেন, আমি ভাবিয়াছিলাম আপন এখানকার একজন ভাল উকিল।”
এই কথাগুলি শুনিযা মুখোপাধ্যায়ের সেই ডাগর চক্ষু দুইটি জলে পূর্ণ হইয়া গেল, হাত দুটি জোড় করিয়া কম্পিত কণ্ঠে বলিলেন – ‘না হুজুর, আমি উকিল নাহ – আমি একজন মোক্তার মাত্র। তাও সেকালের শিথিল নিয়মের একজন মূর্খ মোক্তার। ইংরাজি জানি না হুজুর। আপনি আজ আমার যে প্রশংসা করিলেন আমি জীবনের শেষ দিন অবধি তাহা ভুলিতে পারিব না। এই বুড়া ব্রাহ্মণ আশীর্ব্বাদ করিতেছি, হুজুর হাইকোটের জজ হউন।” – বলিয়া ঝুঁকিয়া সেলাম করিয়া মোক্তার মহাশয় এজলাস হইতে বাহির হইয়া আসিলেন।
ইহার পব আর তিনি কাছারি যান নাই।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
ব্যবসা ছাড়িয়া কায়ক্লেশে মুখোপাধ্যায়ের সংসার চলিতে লাগিল। ব্যয় যে পরিমাণ সঙ্কোচ করিবেন ভাবিয়াছিলেন, তাহা শত চেষ্টাতেও হইয়া ওঠে না। সুদে সঙ্কুলান হয় না মূলধনে হাত পড়িতে লাগিল। কোম্পানীর কাগজের সংখ্যা কমিতে লাগিল।
একদিন প্রভাতে মোক্তার মহাশয় বৈঠকখানায় বসিয়া নিজের অবস্থার বিষয় চিন্তা করিতেছেন, এমন সময় মাহুত আদরিণীকে লইয়া নদীতে স্নান করাইতে গেল। অনেক দিন ‘হইতেই লোক ইহাকে বলিতেছিল-“হাতীটি আর কেন, ওকে বিক্রী করে ফেলুন। মাসে ত্রিশ চল্লিশ টাকা বেঁচে যাবে।” কিন্তু মুখুয্যে মহাশয় উত্তর করিয়া থাকেন-“তার চেয়ে বল না, তোমার এই ছেলেপিলে নাতিনাতিনীদের খাওয়াতে অনেক টাকা ব্যয় হয়ে যাচ্ছে-ওদের একে একে বিক্রী করে ফেল।”-এরূপ উক্তির পর আর কথা চলে না।
হাতীটাকে দেখিয়া মুখোপাধ্যায়ের মনে হইল, ইহাকে যদি মধ্যে মধ্যে ভাড়া দেওয়া যায়, তাহা হইলে ত কিঞ্চিৎ অর্থাগম হইতে পারে। তখনই কাগজ কলম লইয়া নিম্নলিখিত বিজ্ঞাপনটি মুসাবিদা করিলেন:-
হস্তী ভাড়ার বিজ্ঞাপন
বিবাহের শোভাযাত্রা, দূরদূরান্তে গমনাগমন প্রভৃতি কার্যের জন্য নিম্ন স্বাক্ষরকারীর আদরিণী নাম্নী হস্তিনী ভাড়া দেওয়া যাইবে। ভাড়া প্রতি রোজ ৩ টাকা মাত্র, হস্তিনীর খোরাকী ১ টাকা এবং মাহুতের খোরাকী।।০ একুনে ৪।।0 ধার্য্য হইয়াছে। যাঁহার আবশ্যক হইবে, নিম্ন ঠিকানায় তত্ত্ব লইবেন।
শ্রীজয়রাম মুখোপাধ্যায় (মোক্তার) চৌধুরীপাড়া
এই বিজ্ঞাপনটি ছাপাইয়া, সহরের প্রত্যেক ল্যাম্পপোষ্টে, পথিপার্শ্বস্থ বৃক্ষকাণ্ডে, এবং অন্যান্য প্রকাশ্য স্থানে আঁটিয়া দেওয়া হইল।
বিজ্ঞাপনের ফলে মাঝে মাঝে লোকে হস্তী ভাড়া লইতে লাগিল বটে- কিন্তু তাহাতে ১৫।২০ টাকার বেশী আয় হইল না। মুখোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পৌত্রটি পীড়িত হইয়া পড়িল। তাহার জন্য ড়াক্তার-খরচ, ঔষধ-পথ্যাদির খরচ প্রতিদিন ৫।৭ টাকার কমে নির্বাহ হয় না। মাসখানেক পরে বালকটি কথঞ্চিৎ আরোগ্যলাভ করিল। বড়বধূ মেজবধূ উভয়েই অন্তঃসত্ত্বা। কয়েক মাস পরেই আরও দুইটি জীবের অন্নসংস্থান করিতে হইবে।
এদিকে জ্যেষ্ঠ পৌত্রী কল্যাণী দ্বাদশবর্ষে পদার্পণ করিয়াছে। দেখিতে দেখিতে যেরূপ ড়াগর হইয়া উঠিতেছে, শীঘ্রই তাহার বিবাহ না দিলে নয়। নানাস্থান হইতে তাহার সম্বন্ধ আসিতেছে বটে, কিন্তু ঘর-বর মনের মতন হয় না। যদি ঘর-বর মনের মতন হইল, তবে তাহাদের খাঁই শুনিয়া চক্ষুস্থির হইয়া যায়। কন্যার পিতা এসম্বন্ধে একেবারে নির্লিপ্ত। সে নেশাভাঙ করিয়া, তাস পাশা খেলিয়া, ফুলুট বাজাইয়া বেড়াইতেছে। যত দায় এই ষাট বৎসরের বুড়ারই ঘাড়ে। –অবশেষে একস্থানে বিবাহের স্থির হইল। পাত্রটি রাজসাহী কলেজে এল-এ পড়িতেছে, খাইবার পড়িবার সংস্থানও আছে। তাহারা দুই হাজার টাকা চাহে; নিজেদের খরচ পাঁচ শত-আড়াই হাজার টাকা হইলেই বিবাহটি হয়।
কোম্পানীর কাগজের বাণ্ডিল দিন দিন ক্ষীণ হইতেছে-তাহা হইতে আড়াই হাজার বাহির করা বড়ই কষ্টকর হইয়া দাঁড়াইল। আর, শুধু ত একটি নহে-আরও নাতিনীরা রহিয়াছে। তাহাদের বেলায় কি উপায় হইবে?-এই সকল ভাবনা-চিন্তার মধ্যে পড়িযা মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের শরীর ক্রমে ভগ্ন হইয়া পড়িতে লাগিল। একদিন সংবাদ আসিল, কনিষ্ঠ পুত্রটি বি, এ, পরীক্ষা দিয়াছিল, সেও ফেল করিয়াছে। বন্ধুগণ বলিতে লাগিলেন- “মুখুয্যে মহাশয়, হাতীটিকে বিক্রী করে ফেলুন করে’ নাতনীর বিবাহ দিন। কি করবেন বেন বলুন। অবস্থা বুঝে ত কাজ করতে হয়। আপনি জ্ঞানী লোক, মায়া পবিত্যাগ করুন।”
মুখোপাধ্যায় আর কোনও উত্তর দেন না। মাটির পানে চাহিয়া ম্লান মুখে বসিয়া কেবল চিন্তা করেন, এবং মাঝে মাঝে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন। চৈত্রসংক্রান্তিতে বামুনহাটে একটি বড় মেলা হয়। সেখানে বিস্তর গোক বাছুর ঘোড়া হাতী উট বিক্রয়ার্থে আসে। বন্ধুগণ বলিলেন- “হাতীটিকে মেলায় পাঠিয়ে দিন, বিক্রী হয়ে যাবে এখন। দু হাজার কিনেছিলেন, এখন হাতী বড় হয়েছে-তিন হাজার টাকা অনায়াসে পেতে পারবেন।”
কোঁচার খুঁটে চক্ষু মুছিয়া বলিলেন- “কি করে তোমরা এমন কথা বলছ?”
বন্ধুরা বুঝাইলেন-“আপনি বলেন, ও আমার মেয়ের মত। তা মেয়েকেই কি চিবদিন ঘরে রাখা যায়। মেয়ের বিয়ে দিতে হয়, মেষে শ্বশুরবাড়ী চলে যায়, তার আর উপায় কি?
তবে পোষা জানোয়ার, অনেকদিন ঘরে রয়েছে, মায়া হয়ে গেছে, একটু দেখে শুনে কোনও ভাল লোকের হাতে বিক্রী করলেই হয়। যে বেশ আদর যত্নে রাখবে, কোনও কষ্ট দেবে না-এমন লোককে বিক্রী করবেন।”
ভাবিয়া চিন্তিয়া জয়রাম বলিলেন-“তোমরা সবাই যখন বলছ তখন তাই হোক। দাও, মেলায় পাঠিয়ে দাও। একজন ভাল খদ্দের ঠিক কর তাতে দামে যদি দু-পাঁচশো টাকা কমও হয়, সেও স্বীকার।”-মেলাটি চৈত্র-সংক্রান্তির প্রায় পনের দিন পূর্ব্বে আবস্ত হয়। তবে শেষের চারি-পাঁচদিনই জমজমাট বেশী। সংক্রান্তির এক সপ্তাহ পূর্ব্বে যাত্রা স্থির হইযাছে। মাহুত ত যাইবেই-মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের মধ্যম পুত্রটিও সঙ্গে যাইবে।
যাত্রার দিন প্রত্যুষে মুখোপাধ্যায় গাত্রোত্থান করিলেন। যাইবার পূর্ব্বে হস্তী ভোজন করিতেছে। বাটীর মেয়েরস, বালকবালিকাগণ সজলনেত্রে বাগানে হস্তীর কাছে দাঁড়াইয়া। খড়ম পায়ে দিয়া মুখোপাধ্যায় মহাশয়ও সেখানে গিয়া দাঁড়াইলেন। পূর্ব্বদিন দুই টাকার রসগোল্লা আনাইয়া রাখিয়াছিলেন, ভৃত্য সেই হাঁড়ি হাতে করিয়া আসিয়া দাঁড়াইল। ডালপালা প্রভৃতি মামুলী খাদ্য শেষ হইলে, মুখোপাধ্যায় মহাশয় স্বহস্তে মুঠা মুঠা করিয়া সেই রসগোল্লা হস্তিনীকে খাওয়াইলেন। শেষে তাহার গলার নিম্নে হাত বুলাইতে বুলাইতে ভগ্নকণ্ঠে বলিলেন-“আদর, যাও মা, বামুনহাটের মেলা দেখে এস।”-প্রাণ ধরিয়া বিদায়বাণী উচ্চারণ করিতে পারিলেন না। উদ্বেল দুঃখে, এই ছলনাটুকুর আশ্রয় লইলেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
কল্যাণীর বিবাহের সমস্ত কথাবার্তা পাকা হইয়া গিয়াছে। ১০ই জ্যৈষ্ঠ শুভকার্যত্যের দিন স্থির হইয়াছে। বৈশাখ পড়িলেই উভয় পক্ষে আশীর্ব্বাদ হইবে। হস্তী-বিক্রয়ের টাকাটা আসিলেই গহনা গড়াইতে দেওয়া হইবে।
কিন্তু ১লা বৈশাখ সন্ধ্যাবেলা মস মস করিয়া আদরিণী ঘরে ফিবিয়া আসিল। বিক্রয় হয় নাই-উপযুক্ত মূল্য দিবার খরিদ্দার জোটে নাই।
আদরিণীকে ফিরিতে দেখিয়া বাড়ীতে আনন্দ কোলাহল পড়িয়া গেল। বিক্রয় হয় নাই বলিয়া কাহারও কোনও খেদের চিহ্ন সে সময় দেখা গেল না। যেন হারাধন ফিরিয়া পাওয়া গিয়াছে-সকলের আচরণে এইরূপই মনে হইতে লাগিল।
বাড়ীর লোকে বলিতে লাগিল-“আহা, আদর রোগা হয়েছে। বোধ হয় এ ক’দিন ‘সেখানে ভাল করে খেতে পায়নি। ওকে দিনকতক এখন বেশ করে খাওয়াতে হবে।”
আনন্দের প্রথম উচ্ছ্বাস অপনীত হইলে, পরদিন প্রতিবেশী বন্ধুগণ আবার বৈঠকখানায় সমবেত হইলেন। অত বড় মেলায় এমন ভাল হাতীর খরিদ্দার কেন জুটিল না, তাহা লইয়া আলোচনা হইতে লাগিল। একজন বলিলেন-“ঐ যে আবার মুখুয্যে মশায় বললেন “আদর যাও মা, মেলা দেখে এসো’ তাই বিক্রী হল না। উনি ত আর আজকালকার মুর্গীখোর ব্রাহ্মণ নন। ওঁর মুখ দিয়ে ব্রহ্মবাক্য বেবিয়েছে সে কথা কি নিষ্ফল হবার যো আছে। কথায় বলে-ব্রহ্মবাক্য বেদবাক্য।”
বামুনহাটের মেলা ভাঙ্গিয়া, সেখান হইতে আরও দশ ক্রোশ উত্তরে রসুলগঞ্জে সপ্তাহব্যাপী আর এক মেলা হই। যে সকল গো-মহিষাদি বামুনহাটে বিক্রয় হয় নাই-সে সব রসুলগঞ্জে গিয়া জমে। সেইখানেই আদরিণীকে পাঠাইবার পরামর্শ হইল।
আজ আবার আদরিণী মেলায় যাইবে। আজ আর বৃদ্ধ তাহার কাছে গিয়া বিদায় রীতিমত আহারাদির পর আদরিণী বাহির হইয়া গেল।
কল্যাণী আসিয়া বলিল – “দাদামশায় আদর যাবার সময় কাঁদছিল।’
মুখোপাধ্যায় শুইয়া ছিলেন, উঠিয়া বসিলেন। বলিলেন “কি বললি? কাঁদছিল?” “হ্যাঁ দাদামশায়। যাবার সময় তার চোখ দিয়ে টপ টপ্ কবে জল পড়তে লাগল।’
বৃদ্ধ আবার ভূমিতে পড়িয়া দীর্ঘনিঃশ্বাসের সহিত বলিতে লাগিলেন – “জানতে পেরেছে। ওরা অন্তয্যামী কিনা। ও বাড়ীতে যে আর ফিরে আসবে না, তা জানতে পেরেছে।”
নাতনী চলিয়া গেলে বৃদ্ধ সাশ্রুনয়নে আপন মনে বলিতে লাগিলেন- “যাবার সময় আমি তোর সঙ্গে দেখাও করলাম না-সে কি তোকে অনাদর করে? না মা, তা নয়। তুই ত অন্তর্যামী – তুই কি আমার মনের কথা বুঝতে পারিসনি? – খুকীর বিয়েটা হয়ে যাক। তার পর, তুই যার ঘরে যাবি, তাদের বাড়ী গিয়ে আমি তোকে দেখে আসব। তোর জন্যে সন্দেশ নিয়ে যাব রসগোল্লা নিয়ে যাব। যতদিন বেঁচে থাকব, তোকে কি ভুলতে পারব? মাঝে মাঝে গিয়ে তোকে দেখে আসব। তুই মনে কোন অভিমান করিসনে মা।”
সপ্তম পরিচ্ছেদ
পরদিন বিকালে একটি চাষীলোক একখানি পত্র আনিয়া মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের হস্তে হস্তে দিল।
পত্র পাঠ করিয়া ব্রাহ্মণের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হইল। মধ্যমপুত্র লিখিযাছে “বাটী হইতে সাত ক্রোশ দূরে আসিয়া কল্য বিকালে আদরিণী অত্যন্ত পীড়িত হইয়া পড়ে। সে আর পথ চলিতে পারে না। রাস্তার পার্শ্বে একটা আমবাগানে শুইয়া পড়িয়াছে। তাহার পেটে বোধ হয় কোনও বেদনা হইয়াছে-শুঁড়টি উঠাইয়া মাঝে মাঝে কাতরস্বরে আর্তনাদ করিয়া উঠিতেছে। মাহুত যথাবিদ্যা সমস্ত রাত্রি চিকিৎসা করিয়াছে-কিন্তু কোনও ফল হয় নাই-বোধ হয় আদরিণী পার বাঁচিবে না। যদি মরিয়া যায় তবে তাহার শবদেহ কেথিত করিবার জন্য নিকটেই একটু জমি বন্দোবস্ত লইতে হইবে। সুতরাং কর্তা মহাশয়ের অবিলম্বে আসা আবশ্যক।”
বাড়ীর মধ্যে গিয়া উঠানে পাগলের মত পায়চারি করিতে করিতে বৃদ্ধ বলিতে লাগিলেন-“আমায় গাড়ীর বন্দোবস্ত করে দাও। আমি এখনি বেরুব। আদরের অসুখ-যন্ত্রণায় সে ছটফট করছে। আমাকে না দেখতে পেলে সে সুস্থ হবে না। আমি আর দেরী করতে পারব না।” তখনই ঘোড়ার গাড়ীর বন্দোবস্ত করিতে লোক ছুটিল। বধূরা অনেক কষ্টে বৃদ্ধকে একটু দুগ্ধমাত্র পান করাইতে সমর্থ হইলেন। রাত্রি দশটার সময় গাড়ী ছাড়িল। জ্যেষ্ঠপুত্রও সঙ্গে গেলেন। পত্রবাহক সেই চাষী লোকটি কোচ বাক্সে বসিল।
পরদিন প্রভাতে গন্তব্যস্থানে পৌঁছিয়া বৃদ্ধ দেখিলেন সমস্ত শেষ হইয়া গিযাছে। আদরিণীর সেই নবজলধরবর্ণ বিশাল দেহখানি আম্রবনের ভিতরে পতিত রহিয়াছে-‘তাহা আজ নিশ্চল-নিস্পন্দ। বৃদ্ধ ছুটিয়া গিয়া হস্তিনীর শবদেহের নিকট লুটাইয়া পড়িয়া, তাহার মুখের নিকট মুখ রাখিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বারম্বার বলিতে লাগিলেন- “অভিমান করে চলে গেলি মা? তোকে বিক্রী করতে পাঠিয়েছিলাম বলে তুই অভিমান করে চলে গেলি?”
ইঁহার পর দুইটি মাস মাত্র মুখোপাধ্যায়মশাই জীবিত ছিলেন।