harun-salemer-masi-class-twelve

হারুন সালেমের মাসি । মহাশ্বেতা দেবী । দ্বাদশ শ্রেণির চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা

উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য হারুন সালেমের মাসি । মহাশ্বেতা দেবী । দ্বাদশ শ্রেণির চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা গল্পটি WBNOTES.IN ওয়েবসাইটের পক্ষ থেকে এখানে প্রদান করা হলো। দ্বাদশ শ্রেণির চতুর্থ সেমিস্টারের শিক্ষার্থীরা এই গল্পটি ভালো করে পাঠ করে আমাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া হারুন সালেমের মাসি গল্পের প্রশ্নের উত্তর তৈরি করতে পারবে। 

হারুন সালেমের মাসি । মহাশ্বেতা দেবী । দ্বাদশ শ্রেণির চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা : 

 

অঘ্রানের সকালে জলের ওপর ঠান্ডা সর ভাঙেনি, বাস-স্ট্যান্ডের চায়ের দোকানে উনুন ধরেনি, হারা গৌরবির উঠোনে এসে দাঁড়াল। হারার বয়স সাত হলে কী হয়, জ্বরে জ্বরে জিভ এড়ে কথা ওর সড়োগড়ো হয়নি এখনও। মাঝে মাঝে কথা আটকে যায়। হারা বলল, “মা ললে না মাসি। ডেকে ডেকে দেখলাম মা রা দেয় না।”

গৌরবি ওর নিড়িনি আর থলি খুঁজছিল। হাতে নিড়িনি নিয়ে পেট-কাপড়ে থলিটা গুঁজে গৌরবি আর হারার মা বিলের ধারে, খালপাড়ে থানকুনি পাতা তোলে, কচুশাক কাটে। যজ্ঞডুমুরের ডাল, দুর্বোঘাস, বেলপাতা, যা পায় সব ওরা বেচে দেয় যশোদের কাছে। যশোদারা কজন রোজ সকালের গাড়িতে কলকাতা যায়, দুপুরে ফেরে।

গৌরবি যায় না। গৌরবির একখানা পা জন্ম থেকে খুঁতো। গোড়ালি আর পাতা বাঁকা। আঙুলগুলো পেছনে বাঁকানো। গৌরবি তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারে না। শাক-পাতা-গুগলি তুলতে হারার মা-র ওপরই ওর নির্ভর।

ঈশ্বরের জিনিস তো। শাকে-পাতায় দোষ নেই।

হারার কথা শুনে গৌরবি অবাক হয়ে গেল। বলল, “রা কাড়ে না কেন?”

“জানি না।”

“রা”

গৌরবি হারার পেছন পেছন পা টেনে টেনে হারাদের ঘরে গেল। হারার বাবা ঘরামি ছিল। ঘরখানা খুব উঁচু করে বেঁধেছিল। মাথা তুলে দেখতে হত। ঘর তোলার কিছুদিন বাদেই হারার বাবা মরে যায়। ওর মাথার বালিশের নীচে রুপোর হাঁসুলির মতো চকচকে নিয়ড়চাঁদা সাপ ছিল। হাতের আঙুল থেকে বিষ খুব তাড়াতাড়ি মাথায় উঠে গিয়েছিল।

মাদুর মুড়ে হারার বাবাকে উঠোনসই করবার পর ওর সমাজের লোকরাই, “ওঃ। ঘর তুলেছিল যেমন কোঠাবাড়ি” বলে মাটিতে থুতু ফেলেছিল।

তখন হারার মা বুঝতে পেরেছিল অতখানি উঁচু ঘর তোলাটা সমাজের মানুষ ভালো চোখে দেখেনি। মনে করেছে কাঙালের আস্পর্ধা। তোমার ছেলে-বিবির ভিখিরির দশা। তুমি সামান্য ঘরামি। তুমি পালবাবুদের চেয়ে উঁচু ঘর তোল কেন? সেই ঘরেই শুয়েছিল হারার মা। রোজই ওর রাতে জ্বর হয় আর চোখের ওপর হাত চাপা দিয়ে শুয়ে শুয়ে ও কাঁদে। গৌরবির হঠাৎ ভুল হয়ে গেল।
“অ লে……। কাঁদিস না কি?”

বলে নীচু হয়েই গৌরবি মুখ তুলল। পেছনে সরে এল। দরজার কপাট ঠেলে দিয়ে হারাকে বলল, “খবর দে হারা কাকাকে। বল্ মাসি ডাকে।”

হারার কাকা বাস-স্ট্যান্ডে মাঝে মাঝে থাকে, মোট বয়। আজ ছিল না। দুপুর পেরিয়ে বিকেল নাগাদ রাজমিস্ত্রি পাড়ার কজন এসে হারার মা-আয়েছা বিবিকে তুলে নিয়ে গেল। গৌরবি বলল, “সঙ্গে যা হারা। মাটি দে।”

বিকেলের পড়ন্ত আলোয় একা একা যজ্ঞডুমুরের ডাল ভাঙতে ভাঙতে গৌরবির নিজের জন্যে বড়ো কষ্ট হল। হারার মা ছেলের হাতের মাটি পেল, ভাগ্যে ছিল। নিজের ঘরে শুয়ে মরল, কপালে ছিল।

“আমি বা কোথায় মরব, কে মুখ শলা করবে কে জানে।”

এইসব সময়ে গৌরবির বড়ে কষ্ট হয়। ও রেললাইনের দিকে চেয়ে থাকে। কয়েকটা স্টেশনের পথ মাত্র। সেখানেই গৌরবির সমাজের লোকরা জমি পেয়েছে, ঘর বেঁধেছে। ওর ছেলে নিবারণ সেখানেই আছে।

গৌরবিও থাকতে পারত। নিবারণ থাকতে দিল না। মানুষের বউ এসে শাশুড়িকে পর করে। গৌরবির কপালে তা হয়নি। বউ কিছু বলবার আগেই নিবারণ “এবার পুঁটির কাছে যাও গিয়া। মাঝে-মধ্যে আমি খবর দিব।”

“মেয়ের কাছে?”

“কেন, মনে নাই?”

তখনই গৌরবি বুঝেছিল কী ভয়ানক প্রতিহিংসা নিবারণের, কিছুই ও ভোলে না। বাসের কন্ডাক্টরকে জামাই করতে গিয়ে নিবারণের বাবা ঘর তৈরির টাকা ভেঙে ঘড়ি, সাইকেল, টর্চ কিনেছিল। নিবারণের বয়স তখন অনেক কম। সাইকেলটা দেখতে দেখতে ও বলেছিল, “সব একজনকে দিবি? তোমার একটা সন্তান?”

বাপ ছেলেতে খুব বেধেছিল। গৌরবি বলেছিল, “তোর এত রিষ কেন? সময়ে পুঁটি আমায় ভাত দিবে। কোন্ মেয়েটা আজকাল মা-বাপকে দেখে না বল্ল”

“ভালো। সময়ে বুঝা যাবে।” নিবারণ বলেছিল।

তারপর কত বছর ধরে নিবারণ চেষ্টা করে ঘর তুলল, মেঝেটা পাকা করল। নিজে বিয়ে করতে না করতে মাকে ভাত দিতে অস্বীকার হল।

সে আজ আট বছরের কথা। বাসের চাকরি খুইয়ে জামাই বহুদিন ঘরে বসা, মেয়েও এবাড়ি ওবাড়ি কাজ করে। গৌরবি আজ ছ-সাত বছর ধরে এই গ্রামে আছে। মেয়ের বাড়িতে গৌরবির দুরবস্থা দেখে গৌরবিকে এখানে নিয়ে আসে মুকুন্দ। বড়ো জোগাড়ে মানুষ মুকুন্দ, হাতে-পায়ে অসুরের বল। এ তল্লাট দিয়ে তিন-চার জায়গায় জমি করে ফেলেছে। আজকাল মানুষ বড়ো মন্দ হয়ে গেছে। ঘর জমিতে বসত না থাকলেই জবরদখল।

“ঘরটুনি ধরে বসে থাকো পিসি। নিবারণ যা হয় দেবে। উঠোনে যা হয় দুটো শাক-পাতা আজে খেতে পারবে না?”
“বেঁচে থাক বাপ।”

বলে গৌরবি এখানে এসে উঠেছিল। বড়ো যেন ভেতর পানে ঢোকানো গ্রাম। গ্রাম বললে হয়, না বললেও হয়। না বড়ো রাস্তার ওপর, না শহরের খুব কাছে। গৌরবি ভেবে পায়নি এখানে সে কেমন করে এক বেলা দুটো ভাত জোটাবে। নিবারণ এখন প্রাইভেট বাসের টিকিটবাবু। মা-কে মাসে পাঁচটা করে টাকা দিয়েছিল কমাস, তারপর আর দেয়নি।

খিদের জ্বালায় গৌরবি মাঝে মাঝে মেটে আলু সেদ্ধ করে খেয়েছে। কাঠের আগুনের তাতে বসে বসে কত সময়, যেন আগের জন্মে শোনা রূপকথার মতো ঝি-কালের বউ-কালের শোনা কথা মনে পড়েছে। ফেলে আসা দেশে ঘরে শোনা কথা। পুকুরঘাটে বাসন মাজতে মাজতে শোনা কথা।

“অ পারুলের মা। মেয়ারে কেমন বা বিয়া দিছ।”

“ভালো দিদি। চার ওক্ত গরম ভাত খায়।”

গৌরবিকে দেখে দেখে ওই হারার মা বলেছিল, “যখন যেমন তখন তেমন চললে আমানি জোটে না? আমাদের জোটে কেমন করে?”

“কেমন করে?”

“নারকেল পাতা চাঁছ, কাঠি নে কুস্তে বাঁধ। শাক গুগলি, জগডুমুরের ডাল নে যশিদের দাও। বিকেলে পয়সা দে যাবে।”

হারার মা-র নামটা অব্দি গৌরবি জানত না। শুধু রমজানের মাস পালন করতে দেখে বুঝেছিল ওদের সমাজ আলাদা।

“আমার পা ল্যাংড়া, আমি শওরে যাই না। তুই যাস কেন?” গৌরবি জিজ্ঞেস করেছিল।

হারার মা নিশ্বাস ফেলে বলেছিল, “ডরাই দিদি। ভয় হয়।”

না, গৌরবির দাওয়ায় উঠে বসেনি হারার মা রান্নার সময়। কিন্তু উঠোনে বসেছে, উকুন বেছেছে। একই সঙ্গে দুজনে বসে বসে হাটুরেদের বাজার ফেরত ফেলে যাওয়া বাঁধাকপির বুড়ো পাতা, থেঁতলে যাওয়া বিলিতি বেগুন কুড়িয়েছে।

সেই হারার মা ড্যাং-ডেঙিয়ে চলে গেল। বড়ো দুঃখ হল গৌরবির। তারপর মনে হল তার চেয়ে হারার মা ভাগ্যবতী।

“হারাটার কী হল যশি? ওর কাকা নিয়ে গেল?”

“কে জানে মা।”

যশি প্রায় ছুটে চলে গেল। যশিরা হাঁটে না, ছোটে। আসলে ওরা চাল বয়। শহরে যায়। সঙ্গে শাকপাতা, নারকেল পাতার কাঠি, যা পায় নেয়। দাঁড়িয়ে কথা ওরা সকালবেলা বলতে পারে না।

গৌরবি মাথা-নাড়ল। হারা প্রায়ই ওর উঠোনে বসে থাকে। গাছের ছায়ায় ঘুমোয়। মা-র গাছের বঁধুলটা, চিচিঙ্গেটা গৌরবিকে দিয়ে যায়। হারার মাথাটা বড়ো, শরীর রোগা। উপোস করা অভ্যেস হয়ে গেছে বলে চোখে একটা বিজ্ঞ ভাব। যেন ও সব জানে।
“কাকার সাথে গেল, বুঝি?”

ভাবতেই ওর কষ্ট হল। আজ ক-বছর ধরে হারা আর হারার মা ওকে ওর নিঃসঙ্গতা ভুলিয়ে রেখেছে। ওদের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ গৌরবির মনে হল কাপড়খানা কেচে ধুয়ে চুলটা আঁচড়ে একবার নিবারণের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে কেমন হয়?

“দুটো ভাত দে নিবারণ।” বলে কেঁদে পড়লে কি নিবারণ মা-কে ফেলে দেবে?

ভাবতে ভাবতে গৌরবি একটা মস্তবড়ো নারকেল পাতা টানতে টানতে ঘরে ফিরল। পাতা চেঁছে কাঠি বের করা বেশ কাজ। অনেকটা সময় তাতে যায়। বাকি সময়টা আঙুলের আন্দাজে উকুন বেছে বেছে কাটানো যায়। সন্ধেবেলা তো একগাল খুদ চিবিয়ে এক ঘটি জল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেই হয়।

বাড়ি ফিরে গৌরবি দেখল উঠোনে হারা বসে আছে। অবাক হয়ে গৌরবি বলল, “তুই?”

“কাকা আসতে বন্ন।”

“এখানে?”

“বন্ন যেথা খুশি সেথা যেয়ে মর গা।”

“সেকী?”

“বন্ন…….”

হারা আঙুলের কর গুনে গুনে মনে করে করে বলল, “কাকার ঘরে কাকি নেই। কাকা টেনে ঘোরে, দেশে দেশে যায়।”

“তোর নিজের কাকা?”

“মা বলত নিজের নয়।”

“তোর নিজের কে আছে?”

“মা বলত কেও নাই?”

যা দাওয়ায় খেয়ে শো গা!”

গৌরবি নিজে একগাল খুদ খেল, হারাকে একগাল দিল। তারপর চাটাই বিছিয়ে গড়াতে গড়াতে ভেবে-চিন্তে ওর মাথা ঘুরে গেল। হারা কী ওর কাছেই থাকবে নাকি? কী বিপদ, কী বিপদ। ওর নিজের বলতে কেউ নেই?

হারার মা-র কথা মনে পড়ল। ছেঁড়া কাপড় গেরো দিয়ে পরা, রোগা ছিপছিপে মানুষ, একমাথা রুক্ষ চুল। চুলের বাহার খুব। কোঁকড়া, ফুরফুরে। গলায় একটা মাদুলি ছাড়া গয়না নেই। দুঃখীর দুঃখী, দরিদ্রের দরিদ্র। এমন গরিব দেখলে গৌরবির বউকালে শাশুড়িরা বলত, “তেলজল দেও, মাথায় দেউক। ভাত দাও, পেটে খাউক।”

নিজের কেউ থাকলে এমন অবস্থা হত কি? অসম্ভব দুশ্চিন্তা হল গৌরবির। হারার মা-র সাতকুলে কেউ নেই, তা বলে গৌরবি কী করবে? তার নিজের আধপেটা অন্ন জোটে কি না জোটে। তাছাড়া। গৌরবি কেমন করে বা হারাকে ঠাঁই দেয়? হারা কী তার ধর্মের মানুষ, না সমাজের?
হারা ঘুমের মধ্যে অল্প অল্প ফোঁপাচ্ছে।

“বুঝি মা-র কথা ভাবে।” গৌরবি অস্ফুটে বলল। তারপর চাটাইটা নিয়ে হারার কাছে গেল। হারার গায়ে হাত দিয়ে বলল, “কাত ফিরে শো হারা। স্বপ্ন দেখিস, ভয় কী?”

গৌরবি মনে মনে ঠাকুরকে ডেকে চোখ বুজল। দিনমনে ও যা পায় না, স্বপ্নে অনেকসময়ে তা পেয়ে যায়। স্বপ্নের গৌরবির মাথায় তেল জবজব করে, পরনে গোটা কাপড়, পেটে ভাত। স্বপ্নের গৌরবিকে নিবারণ মাথায় করে রাখে। আজ স্বপ্নে ওকে হারার মা হাত ধরে নিয়ে গেল এক আশ্চর্য দেশে। সেখানে থানকুনি পাতা দুর্বোঘাসের মেলা। মাদারগাছের ছায়ায় ঢেঁকিশাকের জঙ্গল। এত শাক-পাতা সব দুহাতে তুলতে তুলতে গৌরবির মনে হল এই তো স্বর্গ। তার স্বর্গ আর হারার মা-র স্বর্গ কি এক হতে পারে? নাকি সব গরিবের স্বর্গ আসলে এক?

সকালবেলা গৌরবি হারাকে বলল, “খালপাড়ে যা হারা। যশিকে বল্ আমার দেহ ভালো নয়, যেন দেখা করে। আর দেখ, যদি কেউ বলে রাতে কোথায় ছিলি, বলিস মাসির উঠোনে। মনে থাকবে?”

হারা ভুরু কুঁচকে একটু বুঝতে চেষ্টা করল। সব কথা ওর মনে থাকে না। সেই জন্যেই ও কর গোনে, নয় তো সুতোয় গিট দেয়। হারা বলল, “লখার মাকে বলব মাসির দেহ ভালো নয়। আর?”

“যদি কেউ বলে রাতে কোথা ছিলি…..”

“বলব মাসির ওটোনে। এই তো?”

“এই ন্যাকড়াটা নে হারা। থানকুনো পাতা তুলবি।”

গৌরবি হাঁড়ি-পাতিল নেড়ে চেড়ে ক-গাল মিয়ানো চালভাজা পেল। হারাকে টোপলা বেঁধে দিল। বলল, “নে। জল খাস। যশি যদি পারে জানি আমার উঠোন ঘুরে যায়।”

হারা চলে গেল। গৌরবি উঠোন ঝাঁট দিল। শুকনো পাতা, কাঠি, শুকনো ডালে জ্বালানির কাজটা চলে। গৌরবির মনে পড়ে ওর মা বামুনদের গাই বিয়োলে বকনা বাছুর এনে পালত। বাছুর বড়ো হত। তার খোল, খড়, গুড় সব খরচা মা দিত। গোবর দিয়ে ঘুঁটে দিত, গুল দিত। বড়ো হয়ে সেই গাই একবিয়ানি হলে মা গাইটা ফেরত দিত, বাছুরটা মা পেত। বকনা হলে পালো, এঁড়ে হলে যাদের হাল আছে তাদের বেচো।

এ গ্রামে যে মানুষ বলতে নেই। গৌরবিকে কেউ অমন একটা বাছুর পালতে দেয়। নিজের বলতে একটা ছাগল। একটা বক্সা গাই থাকলে কি গৌরবির আজ এই দশা হয়?

থলিতে চাল সামান্যই ছিল। চালে, ডুমুরে, মোচার কোলের কচি ফুলটায়, নুনে একসঙ্গে জাউ বসিয়ে দিয়ে গৌরবি ভেবে পেল না এরপর হারা আর ও কেমন করে একবেলা একমুঠো খাবে।

এখন ওর হারার মা-র ওপর রাগ হল। কী বেআক্কেল মানুষ বল, কী অবিবেচক?

“সাতকুলে কেউ নেই, আমার ভরসায় ছেলে রেখে চোখ বুজল। এখন জাত বা কেমন করে থাকে, ধর্মের বা কী হয়।”

খুব রাগ হতে লাগল গৌরবির। কিন্তু অনেক বেলায় হারা যখন এসে বলল, “মাসি মেটে আলু আন্না করবে?” তখন গৌরবির মুখ হাসিতে ভরে গেল।
“কত বড়োটা রে। কোথায় পেলি?”

“ঘরে ছিল। মা বলেছিল…” হারা কর গুনে গুনে বলল, “মাসিকে দিস হারা? আর বলেছিল…”

“কী?”

“মাসির পা ধরে পড়ে থাকিস।”

“বলেছিল।”

গৌরবির শুকনো বুকে যেন কিসের ঢেউ লাগল। নিবারণ যখন ছোটো ছিল সাবিত্রী যখন হামা টানে, তখন ঘর নিকোতে নিকোতে, বাসন মাজতে মাজতে ওদের কান্না শুনলে বুকের ভেতর এমনি হত বটে।

নিবারণ তো ওকে চায় না। সাবিত্রী এখন নিজের সংসারে ভাত জোটাতে হিমসিম খায়। ওদের ওখানে থাকতে তো গৌরবির নিজেকে শুধুই এঁটো পাতা মনে হত, মনে হত গত বছরের মনসাপুজোর ঘটটা যেন। ফেলে দিলেই হয়।

হারার মা ওর কথাই হারাকে বলেছিল। বড়ো ভালো লাগল গৌরবির। নিজেকে বড়ো প্রয়োজনীয় মনে হল হঠাৎ। গৌরবি সামান্য স্নেহমমতায়, মিষ্টি কথায়, আবেগে গলে যেতে পারে। এখন ও নাক টেনে, চোখ মুছে বলল, “দুঃখী আরেক দুঃখীর মন বুঝে। তাই বলেছিল। নে হারা, মেলা কর। পুকুরে যা।”

বিকেলে যশি এসে উঠোনে বসল। যাওয়ার সময় ছুটে ছুটে যায় যশি। ওদের পুরুষরা কোনোদিন ভাত-কাপড় দেয় না, যশির বরও দেয় না। ওদের মেয়েরা আশা করে না পুরুষেরা ভাত-কাপড় দেবে, যশিও করে না। যশিরা শরীরে খেটে সংসার বেঁধে তোলে। ছেলেপিলেকে জন্তুর মতো জাপটে ভালোবাসে আর স্বামীদের খুব তোয়াজ করে ভুলিয়ে রাখে।

যশির নাকটা চাপা কিন্তু মুখখানা বেশ পানপাতার মতো হরতনি ছাঁদের। চোখ দুটো সদাই ঘোরে। এদিক থেকে ওদিক। সবাই বলে যশির চোখ এড়িয়ে কেউ যেতে পারে না। হাঁড়ির ভেতর চাল আছে না ধান আছে, যশি একবার মাত্র চেয়ে বলে দিতে পারে।

“কী গো মাসি! কী বলবে?”

যশির এই গায়ে পড়ে গা দুলিয়ে কথা বলাটা একেবারে পছন্দ নয় গৌরবির। তবে এখন গরজ তার।

“তোরে একটা কথা বলব বলে ডেকেছি।”

“বলো। দাঁড়াও মাসি। ও কে, হারা নয়?”

“ওর কথাই তো বলব।”

“কী?”

গৌরবি একটু ভীতু হাসল। দলে নিতে হবে যশিকে। নইলে গৌরবি হারার ব্যবস্থা করবে কী করে?

“ওর মা তো মরে গেল। ছেলেটা এখানেই ঘোরে যশি, দুটো ভাত খায়, উঠানে ঘুমায়।”

“ঘরে দোরে উঠে বসে না তো? দেখ বাবা, ছোঁয়ানেপায় একাক্কার কোরো না।”

“না না উঠোনে থাকে। ওরই সানকিতে খায়, আমি উপর থেকে ভাত দিই।”

“ওর কেউ নেই?”

“তাই তো তোরে শুধাই যশি, তুই তো যাস শহরে, ওর মতো ছেলেদের কি কোনো ব্যবস্থা আছে?”

“আমি কী জানি?”

“থাকার মধ্যে তো ঘরটুনি শুধু।”

“অঃ। ঘর আবার ওর কী? ঘর বাঁধা তোমার কুটুম ওই মুকুন্দবাবুর কাছে।”

“তাই নাকি?”

“নয় তো কী

“হা ভগবান।”

“এক কাজ করতে পারি।”

“কী?”

“শহরে ছেড়ে দিতে পারি। ভিক্কে করে খাবে।”

“ওই ছেলে!”

“তবে আমার কী? তোমার মাসি ভীমরতি। ভিক্কে করে খাবে খাবে, না খাবে না খাবে, তোমার কী, আমার কী?”

“যশি, সে কথা সত্যি, তবে কি।”

যশি জীবনে কখনো কারো কাছে দয়া পায়নি, এখনো পায় না। ট্রেনে একটু বসার জায়গা, চাল-বেচা লাভের পয়সা ওকে আঁচড়ে-কামড়ে আদায় করতে হয়। সাত বছর বয়েস থেকে না খেটে একবেলা ভাত পেয়েছে মনে পড়ে না যশির। দয়া-টয়া দেখলে ওর অঙ্গ জ্বলে।

গৌরবির কথা শুনে ওর সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল। যশি বলল, “তোমাদের দেশের রীতকানুন জানি না মাসি, তবে মুকুন্দবাবু জানলে পরে তোমায় খেদা করবে।”

“খেদা করবে কী কথা রে? মুকুন্দ আমার কে হয় জানিস?”

“আপনাজনা। তাই যেয়ে শাক-গুগলি কুড়িয়ে বেড়াও আর একবেলা পোষ্টা ভাত খাও।”

গৌরবি কেঁদে ফেলল। যশি বলল, “দয়া দেকালে, দু-গাল মুড়ি দিলে তা বুঝি। তোমার নিজের পেট চলে না তুমি যাও অন্যরে ভালো করতে। আমি বলি শোনো। ওরে শহরে ছেড়ে দে আসি। বাঁচে মরে ও বুঝুক গা। শহরে কী ছেলে বাঁচে না গা? বাজারে আমের আঁটি চুষে, পচা কলাটা বেলটা খেয়ে, ফুটপাতরে ঘুমিয়ে অমন লাখোটা ছেলে বড়ো হচ্ছে না?”

“আচ্ছা শোন, তা যা হবে, একবার এট্টা বুদ্ধি করি।”

“কী?”

“ধর্ নিবারণের কাছে যাই।”

“সে এখন বাড়িতে চাপাকল বসাচ্ছে, ইলেটিরি নেচ্ছে, তোমার কথা কে শুনবে?

“তা’লে?”

“মা বলে যদি ভাবত তা’লে কি তোমার এই অবস্থা হয়? তা’লে। তা’লে কী, তা নিজের কপালকে বলো গা।”

যশি উঠে দাঁড়ালো। বলে গেল, “খাওয়া-দাওয়া ছোঁয়া নেপা ছিষ্টি কোরো না মাসি। তোমার বাগ্যতা করি। মুকুন্দবাবুকে তুমি চেন না, আমরা চিনি। দেশের মানুষ, ঘরের মানুষ বলে ছেড়ে দেবে ও? মুকুন্দবাবু এই বাড়িতে মনসাঘট পুজো করল ভাদ্দরে, পাঁটা কাটল, আমরা সবাই খেয়ে গেলাম। তিনি শুনলে খুব বেজার হবে গো।”

গৌরবির ভেতরটা ভয়ে শুকিয়ে গেল। গৌরবি যশির হাত ধরে বলল, “কারেও বলিস না যশি, তোর পা ধরি। আর শোন্ মেটেআলুটা নিয়ে যা।”

যশি চলে গেল।

গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসল গৌরবি। কী করে এখন ও, কোথায় যায়? মুকুন্দ যদি জানতে পারে তবে যদি রাগ করে?

গৌরবি সাত-পাঁচ ভেবে কাপড়খানা কাচতে বসল। নিবারণ যদি একটা বুদ্ধি দেয়। যদি বলে এসো, আমার কাছে থাকো?

আহা তেমন ভাগ্য কি হবে না? হারার মাকে যখন ওরা গোর দিল, হারাও একমুঠো মাটি দিল।

গৌরবি কি ছেলের হাতের আগুন পাবে না? ভেবে গৌরবির চোখ জলে ভরে গেল।

নিবারণের বাড়ি দেখে গৌরবি আর চিনতে পারে না। টিনের চাল, পাকা দেয়াল, উঠোনে চাপাকল। গৌরবির ঘরের এখানে-ওখানে খড়ের নুটি গোঁজা। বকফুল আর বাঁজা আমগাছটার পাতা পড়ে পড়ে উঠোন নোংরা হয়। সন্ধে হলে শেয়াল উঠোন দিয়ে হাঁটে। সেবার শীতকালে তো খাটাশ না বনবেড়াল এসে ঘরে ঢুকেছিল।

এমন ঘর-সংসার সাজাল নিবারণ, তা সে ঘরে মায়ের জায়গা হয় না।

নিবারণের বউ বলল, “দেখে নজর দিয়ো না মা, নজর দিয়ো না। দুই প্রাণী খেটে-খুটে এটুনি দাঁড় করিয়েছি।”

“না বাছা, লজর দিইনি।”

“এসেছ সব, চা খাও, জল খাও।”

“দে বউ, একটু চা দে।”

“ছেলের সঙ্গে দেখা করো। তবে যেন কাঁদতে বোসো না। বড়ো রাগি ছেলে তোমার।”

“জানি।”

“আর দেখো।”

বউ আকাশের দিকে মুখ তুলে কী যেন ভাবল। তারপর ছেলেকে বলল, “পয়সা নিয়ে দোকানে যা। চা পাতা কিনে আন্। ঠাম্মা চা খাবে।”

ছেলে বেরিয়ে যেতে বউ পেট-কাপড় থেকে দুটো টাকা বের করে গৌরবিকে দিল। বলল, “ছেলেকে বোলো না যেন। এ আমার সুপুরি কেটে উপায় করা। এই কাপড়খানা ধরো। এমন কাপড় পরে আসতে আচে? যে দেখবে সে বলবে কী? তোমার ছেলের একটা নাম-পরিচয় নেই?”

তা বটে।

গৌরবি টাকা নিল, কাপড় নিল। এ কথা তার একবার মনে হল না, মাকে দেখে যদি লজ্জা পায় নিবারণ তবে মাকে যত্ন-আত্তি করে রাখে না কেন?

কিছুক্ষণ পরে গৌরবি কান খাড়া করল। আশ্চর্যের আশ্চর্য। নিবারণের ঘরে রেডিয়ো বাজছে।

“কোত্থেকে এল অ বউ?”

“দোকান থেকে।”

“কত দাম, অ বউ, বল্ না?”

“জানি না মা, হোক-না-হোক দেড়শো টাকা হবে।”

“দে-ড়-শো।”

গৌরবির মাথা ঘুরে গেল। দেড়শো টাকা যদি গৌরবি হাতে পায় তবে এখনি তার কপাল ফেরে।

“আমাকে একশো টাকা দিবি বউ?”

“কোত্থেকে? গাছ থেকে পেড়ে এনে দেব?”

“তবে একটা গোরু কিনি। ঘুঁটে গোবর দিয়ে, দুধ বেচে আমরা দুই প্রাণী বেশ চালিয়ে নেব।”

“দুই প্রাণী?”

“ওই একটা গরিব ছেলে, বউ। মাসি মাসি বলে।”

“তার মা-বাপ নেই?”

“কেউ নেই।”

“কেউ নেই?”

“কেউ নেই রে। বড়ো অভাগা।”

নিবারণ তো সে কথা শুনেই রেগে গেল।

“ওঃ মাসি-বোনপো দুধ খাবে, আমি গোরু কিনে দেব। যাও-যাও, মেলা বোকো না।”

“শোন্ নিবারণ, ছেলেটার কথা শোন….”

“কী কথা?”

“ছেলেটার মা…”

গৌরবি সব বলে গেল। কাঁদতে কাঁদতে, নাক টেনে টেনে।

নিবারণের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। নিবারণ বলল, “তুমি নইলে এমন শত্রু আর কে হবে?”

“আমি তোর শত্রুর?”

“নয় তো কী? এ কথা প্রচার গেলে তোমার আমার প্রাচিত্তির করতে হবে না?”

“কেন? প্রাচিত্তির কেন? আমি কী তাকে ঘরে রাখছি না হাঁড়িতে খাওয়াচ্ছি? গরিবের গরিব হারাটা, তার একটা ব্যবস্থা যদি করে দিস তাই বলছি। এতে প্রাচিত্তিরের কথা ওঠে কোথেকে।”

“ছোটোলোকের সঙ্গে সঙ্গে শাক-পাতা চুরি করে ওইরকম বুদ্ধি হয়েছে তোমার। প্রাচিত্তির করতে হবে, মেয়েটার বিয়ে হবে না, এ-সব কথা তুমি বোঝ? যাও যাও, মেলা বোকো না।”

“তোর কাছে আমায় একটু আশ্রয় দে বাবা।”

“ওঃ, আমি জমিদার তাই তোমায় আশ্রয় দেব।” কী ভেবে নিবারণ বলল, “তবে হ্যাঁ। এখন সমাজে আমার একটু নাম হয়েছে। আমার মা হয়ে ওই অজ গাঁয়ে পড়ে থাকবে সেটা ভালো দেখায় না বটে!”

“তবে?”

“ও পাপ বিদেয় করো। তারপর ভেবে দেখব। খবর দিয়ো, খবর দিয়ো জানলে?”

“ছেলেটা….”

“বিদেয় করো। এখন আমাদের দেশে গাঁয়ে যুদ্ধ হচ্ছে। অজ গাঁয়ে থাক, জানতে পার না কিছু। রোজ কতো লোক এসে এপারে উঠছে। তাদের মধ্যে ছোঁড়াকে ছেড়ে দাও না কেন? বলো তো সেখানে রেখে আসি। কাল পরশু।”

“সেখানে কী হবে?”

“ওকে গরমেন্ট খেতে দেবে, কাপড় দেবে। আমাদের দেশের কথা তোমার মনে পড়ে? আমি তো জ্ঞানে দেখিনি।”

“মনে পড়ে। বউকালে চলে এলাম। দেশ ভাগ তার পরে হল রে।”

“সেখানকার মানুষও আসছে কত।”

“ওখানে ওকে ওরা খেতে দেবে?”

“ফেলে তো দিয়ে আসি। তা বাদে পেলে খাবে, না পেলে না খাবে।”

“মরে যাবে না?”

“মরলে মরবে। রোজ দিন হেথা-হোথা মানুষ মরছে না। ওর কপালে থাকে মরবে।”

নিবারণের হঠাৎ হাসি পেল। বেশ খানিকটা হেসে নিল নিবারণ। তারপর বলল, “এখন এসো। ওর ব্যবস্থা করো, তা বাদে দেখি এখানে তোমায় আনতে পারি কি না। তোমার আবার নাতি হবে যে।”

“সে জন্যে ওনাকে বলা কেন বাপু? শাশুড়ি নিয়ে ঘর করিনি। তা বলে কি আমার তিন-তিনটে ছেলেমেয়ে হয়নি? তোমার মা ডাকতে সাধ হয়েছে তাই বলো। আমার দোহাই দাও কেন?”

“কেন? তোর মা এসে তিন সন্ধে ভাতের থালা মারতে পারে, আমার মা পারে না?”

“ওরে আমার মা-সোয়াগি ছেলে। আমার মাকে তুইয়ে-তাইয়ে তুমি একুশ টাকা নাওনি? শোধ দিয়েছিলে? সে কথা মনে করো একবার?”

“তবে রে।”

দুজনে ধুন্ধুমার ঝগড়া লেগে গেল। গৌরবি ভয়ে ভয়ে বেরিয়ে এল। বাসরাস্তায় হারা বসেছিল। হারাকে বলল “চ হারা, ঘরে যাই।”

দোকানের সামনে এসে হারা বলল, “তুমি যাও। আমি কেরাচিনি নে যাই।”

“পয়সা কোথা পাবি?”

“পয়সা তো আমি দিই না মাসি। আমি ওদের কাঠ এনে দিই, পাতা কুড়িয়ে দিই, উনি আমায় এটুনি কেরাচিনি লম্ফো জ্বালতে দেয়।”

“আন্।”

গৌরবির ইচ্ছে হচ্ছিল হারার ওপর রাগ করে, কিন্তু এখন ওর মনে হল ছেলেটা ভালো। একটু কেরাচিনি দিয়ে বা কে ওকে সাহায্য করে?

রাতে গৌরবি আর হারা ঘর আর দাওয়ায় শুল। হারাকে তাড়াতে পারলে নিবারণ হয়তো ওকে আশ্রয় দেয়, কিন্তু গৌরবির বুকের ভেতরে কে যেন না না বলতে লাগল। সে কী হারার মা না নিবারণের মা, কে গৌরবিকে মানা করতে লাগল।

কদিন বাদে মুকুন্দ এল।

“এ কী কথা শুনছি পিসি।”

“কী কথা?”

“তুমি ওই হারাটাকে আশ্রয় দিয়েছ?”

“আশ্রয় আর কী। ও একা, আমিও একা, সন্ধেবেলা ওই উঠোনে পড়ে থাকে।”

“না পিসি। একথা ভালো নয়। এখন দেখো যেখানে খুনজখম, সেখানে জমির দাম নেই। আমার এ ভিটেটা পালবাবুদের দেব। ওরা পার্টি করে, খুঁটির জোর আছে। ওরা এখানে গুদোম করবে।”

“কীসের?”

“তাতে তোমার কী? এখন পালবাবুরা একথা শুনলে খুব রাগ করবে। ওদের পুজো-আচ্ছা আছে।”

“তবে কী হবে মুকুন্দ?”

“নিবারণ তো ভালো কথা বলেছে। ছেলেটাকে বিদেয় করো, নিজের ঘরে গিয়ে ওঠো বউ তোমার মন্দ নয়।”

“বউ কেন মন্দ হবে। আমার ভাগ্য মন্দ বাবা, কপালটা খারাপ।”

“তা দেখো যা পার করো। তবে ও ছোঁড়াকে যদি বিদায় না কর আমার ভিটে ছেড়ে দাও।”

“ছেড়ে দেব? অ বাপ মুকুন্দ। ছেড়ে আমি কোথায় যাব?”

“তা আমি কী জানি?”

মুকুন্দ জুতো মশমশিয়ে চলে গেল।

গৌরবি হারাকে দেখে পাগলের মতো তেড়ে গেল।

“মর্ মর্। তোর জন্যে আমার এতো দুর্ভোগ। তোর জন্য আমাকে সবাই কুকুরতাড়া করে। মর্ তুই। যেখানে ইচ্ছে বিদায় হ।”

হারা ভয়ে পালিয়ে গেল।

পালিয়ে গিয়ে হারা নিজেদের ঘরে বসে রইল। বসে বসে মা-র জন্যে কাঁদল। কেঁদে কেঁদে যখন হারা ঘুমোল তখন বিকেল হয়ে গেছে। ঘুমের মধ্যে মা যেন তার কাছে যাওয়া-আসা করতে লাগল। যেন কে বলল, চোখ খুললেই হারা দেখবে মা রাঁধতে বসেছে, সব ঠিক আছে।

হারা চোখ খুলল। নিমনিমে অন্ধকার, কে ওকে গায়ে হাত দিয়ে ঠেলছে আর ঠেলছে। মা না কি?

মা তো নেই। মা মরে গেছে। তবে কে?

“মাসি গো।” হারা ভয়ে কেঁদে উঠল।

“ওঠ হারা, আমি মাসি।”

“ওঠ হারা, আমি মাসি।”

“মাসি?”

“হ্যাঁ। চল্ আমরা চলে যাব।”

“কোথা?”

“শওরে।”

“শওরে যে তুমি যাও না, তুমি হাঁটতে পার না যে?”

“পারব হারা। শোন, আমরা শওরে যাব। সেখানে কেউ কারো কোনো কথা জানতে চায় না। কেউ কারে চিনে না।”

“সেথা আমরা কোথা থাকব মাসি?”

“ফুটপাতরে।”

“কী খাব?”

“ভিক্কে করব। কেউ তোর পরিচয় জানবে না, আমার পরিচয় জানবে না।”

“ভিক্কে করব?”

“হ্যাঁ রে। পথে পথে ভিক্কে করব, পথে বসে রাঁধব, ফুটে শোব, কাপড়-ন্যাতা গেরিমাটিতে রং করলে ময়লা হয় না। যশির কাছে আমি সব জেনে নিয়েছি।”

“চলো।”

গৌরবি আর হারা অন্ধকারে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেল। শহরে গৌরবি আর হারার সমাজ অনেক বড়ো। সমুদ্রের মতো। সেখানে একবার মিশে যেতে পারলে আর কোনো ভয় থাকে না।

LINK TO VIEW PDF FILE (ONLY FOR SUBSCRIBERS)

হারুন সালেমের মাসি । মহাশ্বেতা দেবী

দ্বাদশ শ্রেণির চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা অধ্যায়ভিত্তিক প্রশ্নের উত্তর দেখতে নিম্নের লিঙ্কটি অনুসরণ করতে হবে

দ্বাদশ শ্রেণির চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা নোট

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করার প্রচেষ্টা করবেন না !
Scroll to Top