বাংলা ভাষার শব্দ । সপ্তম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ
সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা ভাষার শব্দ । সপ্তম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ প্রদান করা হলো। আমাদের WBNOTES.IN ওয়েবসাইটের পক্ষ থেকে প্রদান করা এই প্রশ্নের উত্তরগুলি তৈরি করে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা তাদের পরীক্ষা প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারবে। আমাদের নোট বিভাগে সপ্তম শ্রেণির বাংলা অধ্যায়ভিত্তিক সমস্ত প্রশ্নের উত্তর প্রদান করা হয়েছে।
বাংলা ভাষার শব্দ । সপ্তম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ :
শব্দভাণ্ডারঃ
পৃথিবীর যেকোনো ভাষার মূল সম্পদ হলো তার শব্দ ভান্ডার। ব্যক্তি ভাষার শব্দ ভান্ডার বলতে সেই ভাষায় লিখিত অলিখিত সমস্ত শব্দকেই বোঝায়। যে ভাষার শব্দভাণ্ডার যত বেশি সমৃদ্ধ সেই ভাষা তত বেশি ঐতিহ্যময়।
যেকোনো ভাষার শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে প্রধানত তিনটি উপায়-
(ক) উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত, প্রাচীন শব্দের সাহায্যে
(খ) অন্য ভাষা থেকে গৃহীত, কৃতঋণ শব্দের সাহায্যে
(গ) নতুন ভাবে সৃষ্ট শব্দের সাহায্যে।
বাংলা শব্দভাণ্ডারঃ
বাংলা শব্দভান্ডারের যতগুলো শব্দ রয়েছে সেগুলি কে আমরা তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করতে পারি। যেমন-
১) মৌলিক শব্দ-(ক) তত্ত্বব (খ) তৎসম (গ) অর্ধতৎসম।
২) আগন্তুক শব্দ-(ক) দেশি শব্দ (খ) বিদেশি শব্দ (গ) প্রাদেশিক শব্দ।
৩) নব্য গঠিত শব্দ-(ক) অবিমিশ্র (খ) মিশ্র।
১) মৌলিক শব্দঃ
প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা থেকে যে সমস্ত শব্দ অবিকৃতভাবে বাংলায় এসেছে অথবা প্রাকৃতের মধ্য দিয়ে কিছুটা রূপান্তরিত হয়ে এসেছে সেগুলোকে বলা হয় মৌলিক শব্দ। মৌলিক শব্দ গুলোকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। যেমন-
ক) তদ্ভব
খ) তৎসম
গ) অর্ধতৎসম।
ক) তদ্ভব শব্দঃ
সংস্কৃত থেকেই প্রাকৃত ভাষার মধ্য দিয়ে সামান্য রূপান্তরিত হয়ে কিছু শব্দ বাংলায় চলে এসেছে, সেগুলিকে বলা হয় তদ্ভব শব্দ।
যেমন- কর্ম (সংস্কৃত) কম্ম (প্রাকৃত) কাম (বাংলা)
খ) তৎসম শব্দঃ
বৈদিক বা সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় সরাসরি গৃহীত শব্দগুলিকে বলা হয় তৎসম শব্দ। যেমন-শ্রদ্ধা, ভক্তি, পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, অন্ন, পাপ, পুণ্য ইত্যাদি।
গ) অর্ধতৎসম শব্দঃ
নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার গৃহীত বহু তৎসম শব্দ লোকের মুখে বিকৃতভাবে উচ্চারিত হয়, সেগুলিকে বলা হয় অর্ধ-তৎসম শব্দ। যেমন-ভক্তি ভক্তি, রত্ন রতন, শক্তি শকতি, ক্ষুধা ক্ষিদে ইত্যাদি।
২) আগন্তুক শব্দঃ
অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মোঙ্গল প্রভৃতি গোষ্ঠীর ভাষা থেকে এবং ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর অন্যান্য শাখার বিভিন্ন ভাষা থেকে আগত শব্দ গুলিকে বলা হয় আগন্তুক শব্দ।
আগন্তুক শব্দের শ্রেণিবিভাগঃ
ক) দেশি শব্দ
খ) বিদেশি শব্দ
গ) প্রাদেশিক শব্দ।
ক) দেশি শব্দঃ
আর্যরা এ দেশে আসার পূর্বে যে সমস্ত প্রাচীন ভাষা প্রচলিত ছিল সেইসব ভাষার বহু শব্দ কখনো সরাসরি আবার কখনো প্রাকৃতের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে সেগুলো দেশি শব্দ। যেমন-
দ্রাবিড় গোষ্ঠীর শব্দ – উলু, ঘড়া, খাল, মেটে, অকাল ইত্যাদি।
অস্ট্রিক গোষ্ঠীর শব্দ – কম্বল, উচ্ছে, ঝিঙে, খোকা, পুরি, ঢেঁকি ইত্যাদি।
মোঙ্গল গোষ্ঠীর শব্দ – ঠাকুর, চরুট ইত্যাদি।
খ) বিদেশি শব্দঃ
বাংলা ভাষায় আগত বিদেশী আগন্তুক শব্দ গুলি এসেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের পূর্বে গ্রীকদের সংস্পর্শে বেশকিছু গ্রিক শব্দ বাংলায় এসেছে। যেমন-
আরবি: আইন, আদালত, কেচ্ছা, কয়েদি, শয়তান, আসামি হাজির, মতলব, গরিব, তামাম, তামাসা, জাহাজ, হুকুম, তাবিজ, কেতাব, সমাজ, ফসল, ফাজিল, তুফান, নমাজ, আল্লা, খুদা ইত্যাদি।
ফারসি: চশমা, চাকরি, কোমর, বেচারা, রাস্তা, কলম, কালি, দোয়াত, ময়দান, খুন, লাল, দোয়াত, সবজি, সাদা,
ময়দা, দোকান, মোজা, মরশুম, কারিগর, কারখানা, দরখাস্ত রাস্তা, শিশি, সিন্দুক, রুমাল, রওনা, বিলেত প্রভৃতি।
ফরাসি: কাফে, রেস্তোরাঁ, কার্তুজ, কূপন ইত্যাদি।
পোর্তুগিজ: আতা, আনারস, আলমারি, আলপিন, পিস্তল, পেয়ারা, পেরেক, আলকাতরা, পেঁপে, কামরা, কামিজ,
সাবান, তোয়ালে, গামলা, বালতি, জানালা, চাবি, বোতল, ইত্যাদি
ওলন্দাজ: ইস্কাপন, রুইতন, হরতন, তুরুপের, ইস্কুপ ইত্যাদি
গ্রীক: সুরঙ্গ, কেন্দ্র, দাম ইত্যাদি।
জার্মানি: নাৎসি, কিন্ডারগার্ডেন, নাজি ইত্যাদি।
চিনা: চা, চিনি, লুচি, লিচু ইত্যাদি।
জাপানি: রিকশা, সুনামি, হাসনুহানা, টাইফুন ইত্যাদি।
বর্মি: লুঙ্গি, ঘুঘনি ইত্যাদি।
তুর্কি: আলখাল্লা, উর্দু, উজবুক, কুলি, কাঁচি, চাকু, দারেগা, বাবা, বন্দুক, বারুদ, বোম, বিবি, বাহাদুর ইত্যাদি।
রুশ: বলশেভিক, সোভিয়েত, স্পুটনিক, ভদকা ইত্যাদি।
অস্ট্রেলিয়া: ক্যাঙ্গারু, বুমেরাং ইত্যাদি। মিশরীয় ফ্যারাও, মিছরি ইত্যাদি।
পেরু: কুইনিন ইত্যাদি।
ইতালীয়: ম্যাজেন্টা ইত্যাদি।
স্পেনীয়: তামাক ইত্যাদি।
ইংরাজি: ভারতবর্ষ ইংরেজদের অধীনে আসার পর বাংলা ভাষায় প্রবেশ করল বহু ইংরেজি শব্দ। যেমন-পেন, পেনসিল, চক, ডাস্টার, স্টেশন, ট্রেন, বাস, ট্রাম, প্লেন, মোটর, রেল, অফিস, স্কুল, কলেজ, লাইব্রেরি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মাষ্টার, সিনেমা, থিয়েটার, অফিস, ব্যাঙ্ক ইত্যাদি।
গ) প্রাদেশিক শব্দঃ
ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন ভাষার ব্যবহার হয়। সেইসব ভাষা থেকে অনেক শব্দ বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডরে প্রবেশ করে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। এগুলিকে প্রতিবেশী বা প্রাদেশিক শব্দও বলা যায়। যেমন-
গুজরাটি: হরতাল, তকলি, গরবা, খাদি, চরকা, বাঈ।
মারাঠি: চৌথ, বর্গি, পেশোয়া, চামচা।
তামিল: চুবুট, চেট্টি, পিলে, খড়া, মোট
তেলেগু: প্যান্ডেল, পিলে।
পাঞ্জাবি: শিখ, ভাঙড়া চাহিদা।
হিন্দি: খানা, কচুরি, কাহিনি, কোরা, হুন্ডি, বানি, চিকনাই, পায়দল, দাঙ্গা, ফালতু, বাত, বিমা, বেলচা, লোটা, খাট্টা, চামেলি, চালু, চাহিদা, লাগাতার, বাতাবরণ, চৌকশ, টিন, ঝাড়, ঝাঙা, ডেরা, তাম্বু, উতরাই, চড়াই, ইস্তক, আলাল, ওয়ালা, কেয়াবাত, কিসান, জওয়ান খান, বিমা, মজদুর, মোকাবেলা, জাহাজ, হাওয়া, হাওয়াই, লোটা, বর্ষাতি, গুণ্ডা, জঞ্জাল, কাহারবা, খাট্টা, গুলতি, ঘাটতি, জনার, জাড়, জিলিপি, দাদি, নয়া, পানি, বাজরা, বর্তন, বোঁচকা, সুলতান, বন্ধ, দেউড়ি, লোটা, চাপকান, চাপাটি, বহুৎ, তাগড়া, সাচ্চা, ফুটা, পুরি, লোটা, চৌকস।
৩) নবগঠিত শব্দঃ
বাংলা শব্দভান্ডারে এমন কিছু শব্দ আছে সেগুলো আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নিজেরাই সৃষ্টি করে নিয়েছি। যেমন-
মিশ্র শব্দঃ
এক শ্রেণির শব্দের সঙ্গে (তৎসম, তদ্ভব, দেশি, বিদেশি) অপর শ্রেণির শব্দ বা প্রত্যয় ইত্যাদির যোগে তৈরি শব্দগুলোকে বলা হয় সংকর বা মিশ্র শব্দ। যেমন-
তৎসম-তদ্ভব – আকাশ গাঙ-আকাশগাও (গঙ্গা)
তদ্ভব-তৎসম – কাজল (কজল) লতা কাজললতা
তদ্ভব-তদ্ভব – বনচাড়াল, পদ্মফুল, আকাশগাঙ।
তদ্ভব-বিদেশি – হাটবাজার, জামাইবাবু, শাকসবজি, কাজকারবার।
তদ্ভব-তৎসম – পাহাড় পর্বত, কাজললতা, মাঝরাত্রি।
বিদেশি-তদ্ভব – মাষ্টারমশাই, ডাক্তার-বদ্যি, অফিস পাড়া, রেলগাড়ি, হাফছুটি ইত্যাদি। বিদেশি বিদেশি-উকিল-ব্যারিস্টার, হেডমিস্ত্রি, হেডমৌলবি, পুলিশসাহেব, জজসাহেব।
বিদেশি প্রত্যয়যুক্ত মিশ্র শব্দ – পণ্ডিতগিরি, বাড়িওয়ালা, দারোয়ান, বাবুয়ানা, চালবাজ, বাজিগর, আত্মদান, ফুলদানি, ঘুষখোর, ডাক্তারখানা ইত্যাদি।
বিদেশি উপসর্গযুক্ত মিশ্র শব্দ – বেহদ্দ, বেহাত, গরমিল ইত্যাদি।
অবিমিশ্র শব্দঃ
ইতর শব্দঃ
বাংলা শব্দভাণ্ডারে লোকপ্রচলিত এমন কিছু শব্দ আছে যা মার্জিত রুচি বা ভাষায় কোনটাই কাম্য নয়। এইধরনের শব্দগুলি ইতর শব্দ নামে পরিচিত।
যেমন-পেঁদানো, গেজানো, গুলমারা।
খণ্ডিত শব্দঃ
এমন কিছু শব্দ আছে যার অংশবিশেষের ব্যবহার করি। এই ধরনের শব্দ উদাহরণ-
টেলিফোন > ফোন
বাইসাইকেল > সাইকেল
এ্যারোপ্লেন > প্লেন
মাইক্রোফোন > মাইক।
অনুকার শব্দঃ
যে শব্দগুলির মধ্য দিয়ে কোনো বিশেষ শব্দের দোত্যনা ফুঁটে ওঠে। যেমন –
ঘেউ ঘেউ, কুহু কুহু, প্যাঁক পাকি, খিচ খিচ।
জোড়কলম শব্দঃ
দুটি শব্দ জুড়ে যখন একটি নতুন শব্দ তৈরি করা হয়। যেমন –
ছবির-কবিতা = ছবিতা
হাঁস-সজারু = হাঁসজারু
ধোঁয়া-কুয়াশা = ধোঁয়াশা।
মুণ্ডমালাশব্দঃ
যে শব্দগুলির আদ্যক্ষর নিয়ে একটি নতুন শব্দ তৈরি হয় সেই শব্দগুলিকে মুণ্ডমালা শব্দ নাম দিয়েছেন। যেমন –
টেলিভিশন > টিভি
হেডমাস্টার / মিস্ট্রেস > এইচ. এম
ভেরি ইম্পটান্ট পার্সন > ভি.আই.পি
প্রমথনাথ বিশী > প্র.নাবি
অনুবাদিত শব্দঃ
যে শব্দগুলি অপর ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় অনুদিত হয়েছে। যেমন –
দূরভাষ, দূরদর্শন, রোদচশমা।